কথাসাহিত্যে প্রেম ও জৈবিক চেতনাঃ প্রসঙ্গ
এপার ও ওপার বাংলার নির্বাচিত উপন্যাস
-ডঃ মীনাক্ষী পাল
“প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে
কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে”-
-কবিগুরুর এই পংক্তির সঙ্গে সহমত পোষণ করে আমরা প্রেমের স্বরূপ সম্পর্কে বলতেই পারি,প্রেম মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান,যা মানবমনকে আষ্টেপিষ্ঠে জড়িয়ে রাখে এবং এই প্রেম মানুষকে দেয় এক অপার তৃপ্তিবোধ। তবে,
প্রেমের
প্রতি
অধিকাংশ
মানবগোষ্ঠীর
প্রচলিত
মনোভাব
আশ্চর্যভাবে
ভিন্ন
ভিন্ন
।
বিভিন্ন
খণ্ডিত
মতবাদের
দিকে
না
গিয়ে
আমরা
সাধারণ
দৃষ্টিতে
প্রেম
বলতে
তাকেই
বুঝি,যেটি শুধুমাত্র জৈবিক আত্মতাগিদকেই বুঝায় না,সেইসঙ্গে যেটি যুগপথ মানসিক ও
দৈহিক
এবং
যথেষ্ট
পরিমানে
আবেগান্বিত। তবে, প্রেম ও
জৈবিক
চেতনা
অতোপ্রতোভাবে
জড়িত
।
সভ্য
মানুষ
তার
জৈবিক
চেতনার
তৃপ্তি
প্রেম
ছাড়া
পেতে
ব্যার্থ। দেহমনময় তার সমগ্রসত্তা কোনপ্রকার সম্পর্কে প্রবিষ্ট না হলে এ অনুভুতির সম্পূর্ণ তৃপ্তি অপূর্ণ থেকে যায়। সচেতম বা
অচেতন
মনে
এ
সত্যের
অনুভবই
প্রেমের
পরিপূর্ণতা
এনে
দেয়
। মোটের উপর বলা চলে, মানুষ থাকলে যেমন মানুষের হৃদয় থাকবে,
তেমনি
আবার
হৃদয়
থাকলে
নরনারী
বিশেষ
অবস্থায়
পরস্পরের
প্রতি
আকৃষ্ট
হবে,এটাই জীবন-সত্য।
সাহিত্যে এই প্রেম বিভিন্ন রঙে, বিভিন্ন আঙ্গিকে হাজার বছর ধরে ব্যক্ত। প্রাচীন সাহিত্য থেকে বর্তমান যুগের সাহিত্যে প্রেমের নিত্য আনাগোনা, আর এই প্রেমে কামনা-বাসনার প্রতিচ্ছবি অদৃশ্যমান নয়, সে শাখা হোক কবিতা-গল্প বা উপন্যাস। বর্তমান প্রবন্ধের শিরোনামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আলোচনা মূলত বাংলা কথা সাহিত্যের দিকেই অগ্রসর করে বিভিন্ন ঔপন্যাসিকের উপন্যাসে প্রেম ও জৈবিক চেতনা কিভাবে পরিস্ফুট হয়েছে তার সম্যক আলোচনার চেষ্টা করা যাক। যদিও কালিক বিবেচনায় বাংলা উপন্যাসের বয়স তেমন দীর্ঘ নয়।
বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস হানা ক্যাথেরিন মুলেন্স’এর ‘ফুলমনি ও করুণার বিবরণ’ প্রকাশিত হয় ১৮৫২ খ্রিঃ। সেদিক থেকে দেখলে বাংলা উপন্যাসের যাত্রাকাল দু’শো বছরকে অতিক্রম করতে পারেনি। ‘ফুলমনি ও
করুণার
বিবরণ’ বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস হলেও এটি সার্থক উপন্যাস যে হতে পারেনি এবিষয়টি সকলরই জ্ঞাত। কিন্তু এর
ছয়
বছর
পর
অর্থ্যাৎ
১৮৫৮
খ্রিঃ
প্রকাশিত
প্যারিচাঁদ
মিত্রের
‘আলালের
ঘরের
দুলাল’ উপন্যাসটিও সমালোচকদের মতে সার্থক উপন্যাসের স্বীকৃতি লাভ করতে পারেনি। তবে
বঙ্কিমচন্দ্র
চট্টোপাধ্যায়
এই
দুর্গম
কাজটিকে
সহজ
করে
দিয়েছিলেন
তাঁর ‘দুর্গেশনন্দিনী
উপন্যাসের
মাধ্যমে
। বলা হয়ে থাকে ১৮৬৫ খ্রিঃ রচিত এই উপন্যাসটিই বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস।
আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে যেহেতু রয়েছে প্রেম ও জৈবিক চেতনা, কাজেই আমরা বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস থেকে শুরু করে বৃহৎ বাংলার উপন্যাসের প্রেমের প্রসঙ্গের উপর দৃষ্টি দেওয়ার চেষ্টা করব। ‘ফুলমনি ও
করুণার
বিবরণ’ উপন্যাসে প্রেম প্রসঙ্গ যে নেই, সেকথা স্পষ্ট করে
বলা
দুষ্কর। তবে প্রেমের প্রসঙ্গ যেটুকু আছে, সেটুকু দৈনন্দিনতার স্বাভাবিকতাকে ম্লান করে
।
এখানে
দেখা
যায়
উপন্যাসের
অন্যতম
প্রধান
চরিত্র ‘করুণা’ সম্পর্কে কথক মেম সাহেবের বর্ণনাটিকে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন যাক-
“স্বামীকে ভাল হইবার লক্ষণ দেখিবা মাত্র তাহার স্ত্রী যে এইরূপ প্রেমের কথা কহিল, তাহাতে আমি উল্লাসিতা হইলেও আশ্চর্য্যজ্ঞান করিলাম না, কারণ যৌবন কালে বিবাহিত স্বামী অপেক্ষা এই
জগতের
মধ্যে
এমত
প্রিয়তম
সম্বন্ধ
আর
কাহারও
সহিত
হয়
না”। ১
-এই উপন্যাসে প্রেমের প্রসঙ্গ এখানেই সীমাবদ্ধ। প্রেমের প্রসঙ্গ যেটুকু আমরা পাই,তা কেবলমাত্র কাহিনীকথক মেম সাহেবের উপলব্ধিজাত বর্ণনামাত্র। তাছাড়া ‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাসেও প্রেম প্রসঙ্গ নিষ্প্রভ ছিল।
‘দুর্গেশনন্দিনী’তে যে প্রেম ছিল রাজা রাজারাজরাদের,কপালকুণ্ডলায় সে প্রেম নেমে এসেছে সাধারণ মানুষের দ্বারে। সেখানে আমরা দেখি অরণ্যলালিতা কপালকুণ্ডলা ও নবকুমারের প্রেমের প্রধান বাধা ছিল কাপালিক এবং শুধু তাই নয়,সে সফলও হয়েছিল। উপন্যাসের সমাপ্তি করুণার উদ্রেক করলেও প্রেমিকা হিসেবে কপালকুণ্ডলা যথাযথই বাংলা সাহিত্যের নতুন সংযোজন হয়েছে,সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
বাংলা কথাসাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের পরে শরৎচন্দ্র,রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ও কল্লোলগোষ্ঠীর ঔপন্যাসিকেরা তাঁদের উপন্যাসে প্রেমকে হাজির করেছেন বিচিত্র প্রেক্ষাপটে, অঙ্কিত করেছেন প্রেমের বহুমাত্রিক কোণ । সম্ভবত সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যুগ
যন্ত্রণার
বাস্তবরূপ
দিতে
গিয়েই
উপন্যাসে
দ্বিমুখী
প্রেম, ত্রিভূজ প্রেম, দেহজ প্রেম, দ্বন্দ ও সংঘাত প্রকট হয়েছে।
১৯০১খ্রিঃ রচিত শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ প্রেমের উপন্যাসের একটি মাইলফলক বলা চলে। শরৎচন্দ্র প্রেমিক হৃদয় উপস্থাপনে তৎপর সাহিত্যিক ছিলেন।
১৯০৩ খ্রিঃ প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ উপন্যাসটিও নানা কারণে আলোচিত। বিনোদিনীর প্রেম ভয়ানক ও বলা চলে উপন্যাসের মূল চালিকাশক্তি।
তাঁর প্রেম কখনো মহেন্দ্রকে টেনেছে,কখনো দূরে সরিয়েছে। কখনো বিনোদিনী বিহারীকে একান্তভাবে চেয়েছে। অন্যদিকে,মহেন্দ্রের ঘরে স্ত্রী আশা আছে,তবু সে
বিনোদিনীকে
পেতে
চায়। বিহারী চরিত্রটি নানাভাবে উজ্জ্বল। অপরদিকে,
দেহমনের
ক্ষুধার
তাড়নায়
চঞ্চলা
বিনোদিনীকে
রবীন্দ্রনাথ
যখন
এঁকেছেন,তখন কোন সামাজিক পূর্ব সংস্কারই তাঁকে আড়ষ্ট করতে পারেনি। তিনি হৃদয়ের আবেদন যা
সত্য
বলে
মনে
করেছেন,তাতে সমাজের অনুমোদন না থাকলেও শিল্পীর সততা ও তৃপ্তি নিয়ে স্পস্টভাবে পরিস্ফুট করেছেন। চরিত্র উপন্যাসের বড়
উপাদান, আর এই চরিত্রের ভাব প্রকাশিত করতে হলে তার বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ ভাববৈচিত্র্যের সংঘাতে উদ্ভূত মনের আলোড়নকে ফুটিয়ে তুলতে হয়,যাতে রবীন্দ্রনাথই পথপ্রদর্শক। নরনারীর হৃদয় প্রেমস্পর্শে সজীব হয় এবং তাতে জীবনের জড়তা কাটে। তবে,
শরৎ
সসাহিত্যের
প্রেমে
সম্ভোগনীতি
অনুপস্থিত
বললেই
চলে। প্রেমের দেহসংশ্লিষ্ট যে উষ্ণ আবেগ আমরা গল্প উপন্যাসে পাই, শরৎ সাহিত্যে তার
অভাব। অথচ হৃদয়গ্রাহিতার দিক দিয়ে শরৎ সাহিত্যে প্রেম রসিক মনকে তৃপ্তি দেয় নিঃসন্দেহে।
শরৎচন্দ্রের ‘গৃহদাহ’( ১৯২০খ্রিঃ) এর সুরেশ ছাড়া বলতে গেলে নারীদেহগত প্রেমের কামনা-বাসনায় আর কেউ সমগ্র জীবনদর্শনকে বাজি ধরেনি এবং বৃহৎ জীবন সঙ্কটে নিজের বৃহৎ সম্ভাবনাময় জীবনকে বলি দেয়নি।
নারীর দেহরূপ অবলম্বন করে প্রেমসঞ্চারের গতির পরিবর্তে শরৎচন্দ্র বরং চেষ্টা করেছেন পুরুষের কামনার উত্তাপ হতে নারীদেহকে আড়াল রাখতে। এই গার্হস্থ সংযমের মাধুর্য স্বীকার করেও এরকম সম্ভোগবিরোধী মনোভাব আধুনিক সাহিত্যবিভাগের উপন্যাস শাখায় হয়তো উৎকৃষ্ট মর্যাদা পাবে কিনা, সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ আছে। ‘গৃহদাহ’তে অচলা অনেকদিন সুরেশের সঙ্গে একবাড়ীতে নিরালায় বসবাস করেও শুধুমাত্র একটি দুর্যোগের রাত্রে লেখকের আভাস অনুযায়ী অন্ধকারে তলিয়া গিয়েছে এবং পরদিন প্রভাতে মড়ার মতো রক্তশূন্য মুখে লোকচক্ষুর সম্মুখে এসেছে।লেখকের বর্ণনায়-
“যে দুর্যোগের রাত্রে সে সুরেশের শয্যায় গিয়া আত্মহত্যা করিয়া বসিল,সেদিন একমাত্র যে তাহাকে রক্ষা করিতে পারিত,সে তাহার অত্যাজ্য সতীধর্ম-”২
তাছাড়া চরিত্রহীন (১৯১৭ খ্রিঃ)-এ কিরণময়ী লেখকের ইতিবৃত্ত বর্ণনার আড়ালেই অনঙ্গ ডাক্তারের কামনা ইন্ধন জুগিয়েছে। ‘শ্রীকান্ত’তে ( ১৯১৭-১৯৩৩ খ্রিঃ) রাজলক্ষী গভীর রাত্রে পা টিপে শ্রীকান্তের শয্যাগৃহে এসে মসারীর কোন তুলে তার কপালে আবেগকম্পিত হাতখানি মাত্র রেখেছে।
‘বিরাজ
বৌ’( ১৯১৪ খ্রিঃ)-এর বিরাজ পরপুরুষের সহিত স্বামীগৃহ ত্যাগ করে বিবরণশূন্য অনেকখানি সময় কাটিয়ে স্বামীর কাছে ফিরল। নারীপুরুষের আদিম জৈবিক সম্পর্ক বর্ণনা বলতে গেলে এখানেই শেষ।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসে প্রেম ও প্রেমের তাড়নায় জৈবিক চেতনা অনেকটাই স্পষ্ট শরৎচন্দ্র অপেক্ষা। তাঁর ‘পদ্মানদীর মাঝি”(১৯৩৬ খ্রিঃ)-তে কুবের মাঝ ও কপিলার প্রেম অন্তজ শ্রেণীর মানুষের জীবনকে চিত্রিত করেছেন অদ্ভূত সরলতায়। ‘চোখের বালি’র মহেন্দ্র যেমন প্রেমের তৃপ্তির আখাঙ্খায় পরকীয়ায় আশ্রয়ী, পদ্মানদীর মাঝি’র কুবেরও একই নেশায় নেশাগ্রস্ত।
কপিলা পরপুরুষের স্ত্রী হওয়া স্বত্তেও তার বড়বোনের স্বামীর প্রতি তার মনে কামনা বাসনার উদ্রেক হয়। প্রেমে কুবের ও কপিলা আত্মমগ্ন হয়েছে। তাতে কুবের পত্নী পঙ্গু মালার যতই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থাকুক না কেন,মালা মালা চেয়েছিল কপিলা ফিরে যাক তার স্বামীর কাছে, কিন্তু শেষপর্যন্ত দেখা যায় ময়নাদ্বীপে কুবেরের সঙ্গী হয়েছে কপিলাই। কুবেরের প্রতি তার আকুতিভরা উচ্চারণ-
“আমারে নিবা মাঝি লগে”৩ -শেষ পর্যন্ত সফল হয়।
উপন্যাসে দেহজ প্রেমের খোলামেলা উপস্থাপন কল্লোলগোষ্ঠীর হাত ধরেই প্রকটভাবে দেখা যায়। রবীন্দ্র সাহিত্য ও
রবীন্দ্রপূর্ব
সাহিত্যে
প্রেমে
জৈবিক
চেতনার
বিষয়টি
প্রচ্ছন্ন
ছিল, বলা চলে রেখে ঢেকে দায় সারানো কাজ। কিন্তু,
কল্লোলগোষ্ঠীর
লেখকেরা
শুধুমাত্র
দেহবাদীই
ছিলেন
না, ছিলেন দেহবিলাসীও। যার
ফলে
লেখকদের
বিরুদ্ধে
প্রবলভাবে
অশ্লীলতার
অভিযোগও
উঠে। আসলে, কল্লোলের উদ্দেশ্যই ছিল প্রবল বিদ্রোহ ও পালাবদল ঘটানোর প্রচেষ্টা। আর
তার
মূল
লক্ষ্য
রবীন্দ্রনাথ। তার কারণ হিসেবে যুদ্ধত্তোরকালের অস্থিরতাকে ধরে নেওয়া যেতে পারে, সঙ্গে পাশ্চাত্যের বাস্তববাদী সাহিত্য আন্দোলনের ঢেউ তাদের
মননভূমিতে ক্রিয়াশীল হয়। বিশেষ করে- গুস্তাভ ফ্লবেয়ার,
এমিল
জোলা,নূট হামসূন ও জন বোয়ারের রচনা বাঙালি তরুণ লেখকদের প্রভাবিত করে বলে ধারণা করা হয়। সেইসঙ্গে,
প্রথম
বিশ্বযুদ্ধের
প্রাককালে
ইংরেজিতে
অনুদিত
ফ্রয়েডের
মনবিকলন
তত্ত্ব
এবং
হ্যাভলক্
এলিসের ‘ স্টাডি ইন দ্যা সাইকোলজি অব সেক্স’ যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের তরুণ যুবমানসকে নতুন ভাবনায় ভাবিত করে । ফলে, প্রচলিত প্রেম ভাবনায় দেহাতীত ধারণার পরিবর্তে দেহবাদী প্রেমের নতুন তত্ত্বের দিক
উন্মোচিত
হয়। এসকল একাধিক কারণে কল্লোলগোষ্ঠীর লেখকেরা প্রেমের ক্ষেত্রে
অনিবার্য দেহের দাবিকে স্বীকৃতি দিয়ে বিদ্রোহে নামেন। তবে সেটা করতে গিয়ে যৌনতাকে তারা যে পরিমান গুরুত্ব দিয়েছেন, সে পরিমানে শিল্প সার্থকতার দিকে নজর দিতে পারেননি বলেই ধারণা করা হয়।
এপ্রসঙ্গে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘বেদে’(১৯২৮ খ্রিঃ) উপন্যাসের আলোচনায় অনুপ্রবেশ করলে দেখা যায়- পচনা,
আহ্লাদী,
নটরু, মাষ্টার অধিকাংশ প্রধান চরিত্ররাই জৈবিক চেতনার দ্বারা পরিচালিত। বহু
চরিত্র
আবার
ছন্নছাড়া
ভবঘুরে। কাহিনীতে আমরা দেখি, প্রচণ্ড জৈবিক তাড়নায় আহ্লাদী রাতের অন্ধকারে নটরু ও পচা দুজনকেই বুকে জড়িয়ে ধরে চুম্বনের দ্বারা উত্তেজিত করতে চায়। মাস্টার এই
ঘটনা
জানার
পর
আশ্রমের
পাশ্ববর্তী
ডোবার
ধারে
একটি
গৃহ
নির্মাণ
করে
আহ্লাদীকে
পৃথক
থাকার
ব্যাবস্থা
করে
এনং
বছরের
পর
বছর
ধরে
সে
ও
আহ্লাদী
দেহসম্ভোগে
তৃপ্ত
হয়। যৌন তৃপ্তি পূরণের জন্য সে
স্থান-কাল-পাত্রের বিচার করে না। মাস্টারের কাছে সে
সেটা
পায়
বলে
পচা
ও
নটরুর
কোন
খোঁজ
খবর
নেওয়ার
প্রয়োজন
বোধ
করে
করে
না। উপন্যাসের শেষে যদিও মাস্টারের চেষ্টায় গর্ভপাত করতে গিয়ে আহ্লাদীর মৃত্যু ঘটে।পচার জবানীতে লেখক জানিয়েছেন-
“বাতিটা উস্কে দিয়ে দেখলাম, আহ্লাদি মাটির উপর লুটিয়ে প’ড়ে গোঙাচ্ছে; ভালো ক’রে চেয়ে দেখি, ওর পায়ের কাছে একটা মেয়ে; মরা। মাটি রক্তে ভেজা---
আহ্লাদির গা ঠেলা দিয়ে ডাকি- আহ্লাদি! আহ্লাদি!-
ওর গা ঠাণ্ডা!” ৪
অপরদিকে, উপন্যাসের নায়ক পচা, সেও প্রবলভাবে যৌনতার দ্বারা প্রভাবিত।আহ্লাদী,
আশমানী, বাতাসি, মুক্তা, বনজোৎস্না, মৈত্রিয়ী ছাড়াও ছপ্পুর বউ ,গঙ্গার ঘাটে পূজা দিতে আসা
একটি
মেয়ে- সকলের প্রতিই ছিল তার দৈহিক আকর্ষণ। ছপ্পুর বউকে সে
এক
খাটে
ঘুমানোর
প্রস্তাবও
দেয়। তবে সে একজনের দেহসান্নিধ্যে আবদ্ধ থাকে না, এক পর্ব চুকে গেলে সে
আরেকজনের
দেহ
সান্নিধ্য
পাওয়ার
আশায়
বেরিয়ে
পড়ে
।
অসংযত আদিম প্রবৃত্তিকে কেন্দ্র করে
প্রতিটি
চরিত্র
আবর্তিত। যেখানে প্রেম সম্পূর্ণ মাত্রায় অনুপস্থিত।
সাহিত্যে প্রেম ও জৈবিক চেতনার আলোচনা সম্পূর্ণ হয় না যতক্ষন না এপার বাংলার কথাসাহিত্যের অনুষঙ্গে অপার বাংলায় রচিত সাহিত্যের আলোচনা না হয়। প্রসঙ্গক্রমে আমরা অপার বাংলার বিখ্যাত ঔপন্যাসিক জহির রায়হানের বিখ্যাত উপন্যাস ‘ হাজার বছর ধরে’(১৯৯৮ খ্রিঃ) আলোচনা করতে পারি।
জহির রায়হানের মন্তু মিয়া চরিত্রটিও প্রেমে উজ্জ্বল একটি চরিত্র এবং সেইসঙ্গে দ্বৈত প্রেমিক চরিত্রও বটে। তার এই দ্বৈত চরিত্রের কারণ হিসেবে খুঁজে দেখতে গেলে আমরা যা পাই, তা হল সে নিজের উপর স্থিতিশীলতার অভাব। আর সেই কারণেই সে টুনিকে আম্বিয়াকে যেমন বিয়ের জন্য কথা দেয়,সংসার পাতার কথা বলে,তেমনি আবার টুনির প্রতিও তার ভালোবাসার কমতি থাকে না। টুনির বৃদ্ধ স্বামী মকবুলের মৃত্যুর পর টুনিকে তার বাপের বাড়িতে দিয়ে আসার জন্য যখন মন্তু নৌকা নিয়ে রওয়ানা হল, পথা শান্তির হাটের কিনারে এসে ভাটার স্রোতে ধীরে ধীরে নৌকাটাকে থামিয়ে দিলে যখন টুনি কারণ জিজ্ঞেস করে, তখন মন্তুর মনের সুপ্ত বাসনার বিস্ফুরণ ঘটে। সে বলে-
“মানোয়ার হাজীরে কথা দিছিলাম ওর ওইখানে এক রাইতের লাইগা নাইয়র থাকুম। চলো
যাই”। ৫
সে আরো জানায়,মানোয়ার হাজীরে বল্লে সে মোল্লা ডেকে সব ঠিক করে দেবে। কিন্তু,তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে বলে টুনি মতপ্রকাশ করে এবং সে রাজী হয়না। কারণ, একদিকে তার স্বামী সদ্য প্রয়াত, অন্যদিকে আম্বিয়া-মন্তুর বিয়ের পাকা কথাও হয়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, আম্বিয়ার ঘরে মন্তুর ঘনিষ্ট যযাতায়াতের কথাও সালেহা ও ফকিরের মা’র আলোচনা থেকে জানতে পেরেছে।তারা বলাবলি করছিল-
“আম্বিয়ার চাচা আজ বলেছে সামনের শুক্রবার জুমার নামাজের পর গাঁয়ের মাতবরদের কাছে তুলবে সে। বিচার চাইবে। এই যে রাত বিরাতে আম্বিয়ার সঙ্গে মন্তুর এত অন্তরঙ্গ মেলামেশা-এ শুধু সামাজিক অন্যায় নয়, অধর্মও বটে”।৬
-এই উপন্যাসে জহির রায়হান প্রেমের উপস্থাপনে ও বিস্তারে ইঙ্গিতের আশ্রয় নিয়েছেন। খোলামেলা সম্ভোগ বর্ণনা এখানে অনুপস্থিত। টুনির প্রতি মন্তুর ভালোবাসা এবং মন্তুর প্রতি টুনির ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে তাদের প্রাত্যহিক আচরণে। টুনি মন্তুকে ভালোবাসে বলেই আম্বিয়া ও
মন্তুকে
নিয়ে
সালেহার
মসকরা
বৃদ্ধ
মকবুলের
তৃতীয়
বিবি
যুবতী
টুনির
সহ্য
হয়
না, সে রেগে যায়। টুনির ক্রোধ দেখে সালেহা যখন
বলে-
“আমরা না হয় মন্তু মিয়া আর আম্বিয়ারে নিয়া একটুখানি ঠাট্টা মসকরা কইরতাছিলাম,তাতে টুনি বিবির এত জ্বলন লাগে ক্যান?”। ৭
একথার প্রতিক্রিয়া হিসেবে লেখক জানিয়েছেন--
“পরক্ষণেই একটা অবাক কাণ্ড করে বসলো টুনি। সালেহার চুলের গোছাটা ধরে
হ্যাঁচকা
টানে
ওকে
মাটিতে
ফেলে
দিল। তারপর চোখেমুখে কয়েকটা এলোপাতারি কিল ঘুষি মেরে দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে গেলো টুনি”।৮
--ঔপন্যাসিক টুনির মধ্য দিয়ে এভাবেই মন্তুর প্রতি তার অনুরাগের ভাব ব্যক্ত করেছেন উপন্যাসটিতে।
এপার ও অপার বাংলা ছাড়া আরেকটি যে বাংলা সাহিত্যচর্চার ভুবন রয়েছে,যাকে অনেকে উত্তর-পূর্ব ভারত বা তৃতীয় ভুবন বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাহিত্য নামে অভিহিত করেন,সেদিকে যদি দৃষ্টি দেই তাহলে সেখানকার ঔপন্যাসিকদের রচনাতেও আমরা প্রেম ও জৈবিক চেতনার বিষয়টি লক্ষ্য করতে পারি। এপ্রসঙ্গে এখানে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিশেষত ত্রিপুরার প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক বিমল সিংহের “তিতাস থেকে ত্রিপুরা”(১৯৮৭খ্রিঃ) উপন্যাসের আলোচনায় দেখতে পাওয়া যায়,সেখানেও মাখন ঠাকুরকে তার
প্রেমিকা
সুমিত্রা
যে
কিনা
পরস্ত্রী হওয়ার পরও
ভিক্ষুকরূপী
ঠাকুরকে
তার
স্বামীর
গৃহে
দেখতে
পেয়ে
তাকে
মধ্যাহ্নভোজন
করায়
ও
ভোজন
শেষে
বিদায়
বেলায়
জৈবিক
চাহিদার
কাছে
হার
মানতে
দেখা
যায়
পূর্ব
প্রেমিক
মাখন
ঠাকুরের
কাছে। ঘরের কোনে সবার আড়ালে সুমিত্রা মাখন ঠাকুরকে জড়িয়ে ধরে বলে-
“একটু আদর কইর্যা যাও। বাওনের পুত মনডা লয়া গেছে। কি
জ্বালায়
জইল্যা
মরি। টের পাওনা । যাও। তবে কইলাম আবার আইবা”। ৯
-যদিও ঔপন্যাসিক এ ঘটনার সাক্ষী হিসেবে সুমিত্রার স্বামীর বড় দিদিকে এনে দাঁড় করিয়েছেন। প্রকাশ্যে এই
সম্ভোগের
কথা
উপন্যাসে
বলেননি। সংক্ষিপ্ত পরিসরে বাংলা কথা সাহিত্যের আঙ্গিনায় প্রেম ও সেই সঙ্গে জৈবিক চেতনা যেভাবে ধরা দিয়েছে এপার ও অপার বাংলা সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উপন্যাসে তা তুলে ধরার প্রয়াসমাত্র এখানে করা হল।
তথ্যসূত্রঃ
১। হানা
ক্যাথরিন ম্যুলেন্স, “ফুলমনি ও
করুণার বিবরণ”, আর্টস ই বুক, bdnews.com থেকে ১১/০৩/২০১১ খ্রিঃ প্রকাশিত,
পৃঃ- ১৬২।
২।চট্টোপাধ্যায় শরৎচন্দ্র, “গৃহদাহ”, প্রকাশক দে’জ পাবলিকেশন, কলকাতা, প্রথম সংস্করণ,
অক্টোবর ২০০০ খ্রিঃ, পৃঃ- ১৮৩।
৩। বন্দ্যোপাধ্যায়
মানিক, “পদ্মানদীর মাঝি”,
প্রকাশক বেঙ্গল পাবলিশার্স, কলকাতা, দ্বাত্রিংশ মুদ্রণ, ২০০১ খ্রিঃ, পৃঃ- ৪২ ।
৪। সেনগুপ্ত
অচিন্তকুমার, “বেদে”,
সিগ্নেট প্রেস, কলকাতা,
প্রথম সংস্করণ, আশ্বিন ১৯৪৭ খ্রিঃ, পৃঃ- ৩১ ।
৫। ডঃ
আশ্রাফ সিদ্দিকী সম্পাদিত,
জহির রায়হান রচনাবলী,প্রথম খণ্ড, আহমদ পাবলিশিং হাউস,প্রথম সংস্করণ, ষষ্ঠ মুদ্রণ ফেব্রুয়ারী ২০০৯ খ্রিঃ, ঢাকা, বাংলাদেশ, পৃঃ-১৪৯।
৬। ডঃ
আশ্রাফ সিদ্দিকী সম্পাদিত,
জহির রায়হান রচনাবলী,প্রথম খণ্ড, আহমদ পাবলিশিং হাউস,প্রথম সংস্করণ, ষষ্ঠ মুদ্রণ ফেব্রুয়ারী ২০০৯ খ্রিঃ, ঢাকা, বাংলাদেশ, পৃঃ-১৪৫।
৭। ডঃ
আশ্রাফ সিদ্দিকী সম্পাদিত,
জহির রায়হান রচনাবলী,প্রথম খণ্ড, আহমদ পাবলিশিং হাউস,প্রথম সংস্করণ, ষষ্ঠ মুদ্রণ ফেব্রুয়ারী ২০০৯ খ্রিঃ, ঢাকা, বাংলাদেশ, পৃঃ-১২৬।
৮। ডঃ
আশ্রাফ সিদ্দিকী সম্পাদিত,
জহির রায়হান রচনাবলী,প্রথম খণ্ড, আহমদ পাবলিশিং হাউস,প্রথম সংস্করণ, ষষ্ঠ মুদ্রণ ফেব্রুয়ারী ২০০৯ খ্রিঃ, ঢাকা, বাংলাদেশ, পৃঃ-১২৬।
৯। সিংহ বিমল, “তিতাস থেকে ত্রিপুরা”, নবচন্দনা প্রকাশনী, প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারী ১৯৮৭ খ্রিঃ, আগরতলা, ত্রিপুরা, পৃঃ-৫৩ ।
*************************************************************************************
লেখক পরিচিতিঃ
ডঃ মীনাক্ষী পাল
লেখক,গবেষক
অসম
ইমেইল-minakshipaul21dec@gmail.com