Wednesday 23 September 2020

আধুনিক বাংলা কবিতায় বর্ষা প্রসঙ্গ ও মেঘদূতের প্রভাব

 

                      

                              আধুনিক বাংলা কবিতায় বর্ষা ও মেঘদূত প্রসঙ্গ

                                                                                                                                                             -ডঃ মীনাক্ষী পাল

       অপরুপ এই রূপবৈচিত্র্যের দেশে ঋতুবৈচিত্র্যের মধ্যেও বর্ষাকে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়কারণ, এর সবুজ বনানী, বয়ে চলা নদী, নদীতে পাল তোলা নৌকা, মাঠে মাঠে সবুজ ধান,পাহাড়, সুনীল আকাশ-এসবই বর্ষাকে দিয়েছে এক অন্য মাত্রা, যা একজন মানুষকে করে তোলে ভাবুকআর, এই ভাবুকিস্বত্তা থেকেই জন্ম নেয় কবিতা, আর সেখানে বর্ষা প্রসঙ্গ থাকাটাই সমীচিনএই বর্ষা ঋতু কবিদের মন ও আবেগকে আলোড়িত করে তোলে এবং কবিদের কলম ভেদ করে লেখনী হয়ে উঠে আসে-

                            আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে

                            জানি নে, জানি নে, কিছুতে কেন যে মন লাগে না ।।

    বৃষ্টির আনন্দবিহ্বল কবি আবার বলে উঠেন আপনমনে-

                       ওরে বৃষ্টিতে মোর ছুটেছে মন, লুটেছে এই ঝড়ে-

                            বুক ছাপিয়ে তরঙ্গ মোর কাহার পায়ে পড়ে

       বর্ষা তার ঝরঝর নির্ঝরণীতে আমাদের মনকে আনন্দ বেদনা ও বিরহকাতরতায় সিক্ত করে তোলেসেইসঙ্গে প্রকৃতিকেও প্রাণরসে সজীব করে তোলে, সবুজে সবুজে ভরিয়ে দেয় আমাদের চারপাশসবুজের সমারোহে নতুন প্রাণের বার্তা নিয়ে হাজির হওয়া এই বর্ষা প্রসঙ্গতই মেঘদূতের বার্তা নিয়ে আসে কবির মননে

        গ্রীষ্মের দাবদাহে মানুষ যখন অতীষ্ট, তখনই বর্ষা আসে প্রশান্তির নির্ঝরণী ধারা নিয়েবর্ষা বাঙালির প্রিয় ঋতু, বিরহেরও ঋতু বটেবর্ষার অপরূপ দৃশ্য যেমন আমাদের মনে কুহুক জাগায়, ঠিক অপরদিকে বিষাদও এনে দেয়বর্ষা একাধারে মানবমনে শিহরণ জাগানো ও উদাসীনতায় ডুবানোর কাজটিও করে নেয় অবলীলায়বর্ষার এই মায়াবী রূপ আমাদের মনকে মোহিত করে, যার দর্শনে হৃদয়মন পুলকিত হয়বিশেষ করে, বর্ষার উথালি-পাথালি ঢেউ আমাদের মনকে সিক্ত করে আর তখনই আমরা হারিয়ে যাই স্বপ্নালোকেআবার কখনোবা প্রিয়তমের দর্শনলাভের জন্য ব্যাকুল করে তোলে, আবার কখনো প্রিয়তমের বিচ্ছেদ-ব্যাথায় বর্ষার জলধারার মতো চোখের জল ঝরতে থাকে কপোল বেয়ে আর এই বর্ষাকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যে ব্যাপক কাজও হয়েছেলেখা হয়েছে অনেক প্রেম ও বিরহের গল্প, কবিতা, গানবিশেষ করে বাংলা কবিতায় প্রাচীন সাহিত্য থেকে শুরু করে আধুনিক সাহিত্য পর্যন্ত বর্ষার নিত্য আনাগোনা প্রাচীন সাহিত্যে  বর্ষাকে বিরহের ঋতু হিসেবে চিত্রায়িত করতে দেখা যায়বৈষ্ণব কবিদেরকেও বর্ষার সঙ্গে বিরহের একটি নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করতে দেখা যায়বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস ও গোবিন্দদাসের রচনায় বর্ষা আর বিরহ একাকার হয়ে গেছে

         মধ্যযুগের চণ্ডীদাসের কোন কোন কবিতায় বর্ষা এসেছে রাধাকৃষ্ণের প্রেমের ইন্ধন হিসেবেসেখানে কবিরা বর্ষাকে অভিসার ও বিরহপর্বেপ্রেমের আগুনে ঘিয়ের ছটাস্বরূপ কল্পনা করেছেনবড়ু চণ্ডীদাসেরশ্রীকৃষ্ণকীর্তনকাব্যে কৃষ্ণের জন্য রাধার বিরহের যন্ত্রনা বেড়ে যায় এই বর্ষা এলেই

         বাংলা কবিতায় বর্ষার বন্দনা পরিলক্ষিত সেই প্রাচীন  যুগ থেকে বর্তমানেওএকটা বিষয়ে সকলেই  জ্ঞাত যে, এই বর্ষাই ছিল কবিশ্রেষ্ট কালিদাসের  সংস্কৃত কাব্যমেঘদূতম্‌’ এর মূল উপজীব্য বিষয়মূল কাব্যমেঘুদূতম্‌’ (১৭ অক্ষর ও ৪ চরণের শ্লোক রচিত ১১৮টি শ্লোক সমষ্টি পূর্বমেঘ ও উত্তরমেঘ এই দুই ভাগবিশিষ্ট এক রোমাণ্টিক প্রেমকাব্য) প্রাচীন টিকাকারদের মতে একটি কেলীকাব্য, ক্রীড়া কাব্য, খণ্ডকাব্য বা মহাকাব্য, আধুনিক গবেষকগণ এটিকে বর্ষাকাব্য,বিরহকাব্য, বা গীতিকাব্য নামেও অভিহিত করেনমান্দাক্রান্তা ছন্দে রচিত এই কাব্য কালিদাসের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় এবং সম্পূর্ণ মৌলিক রচনাআবার, শুদ্ধ বিরহকে অবলম্বন করে সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথম ও পূর্ণাঙ্গ কাব্যমেঘদূতম্‌’প্রসঙত উল্ল্যেখ্য যে, কালিদাস বিরচিত এই মূল কাব্যের অনুবাদ কাব্যমেঘদূতবাঙালি কবিস্বত্তায় সহজেই স্থান করে নেওয়াটা সেকারনেই স্বাভাবিক ছিল এবং যার প্রতিফলন আমরা অধিকাংশ কবির কাব্যে পাই

     পূর্বমেঘের শ্লোকসংখ্যা ৬৩ ও উত্তরমেঘের ৫৪ যদিও এই খণ্ড বিভাজন কবিকৃত নয়পূর্বমেঘঅংশের বর্ণনা, অন্যদিকেউত্তরমেঘঅংশের আলোচ্য বিষয়-কুবেরপুরী অলকার বিলাসবৈভব ও যক্ষপ্রিয়ার বর্ণনাকালিদাসেরমেঘদূতকাব্যের আলোচ্য বিষয় নিসর্গ বর্ণনাসারবস্তুটি সরল,অথচ কাব্যগুণসমন্বিত; কর্তব্যে অসাবধানতায় প্রভুর অভিশাপে যক্ষকে রামগিরি পর্বতের বিজন আশ্রমে নির্বাসিত হতে হয়সেখানে বসে  আষাঢ়ের প্রথম দিবসে নববর্ষার মেঘ দেখে তারই মাধ্যমে অলকাপুরীর রম্যপ্রাসাদে তাঁর বিরহী প্রিয়ার উদ্দেশ্যে বার্তা প্রেরণ করবেন বলে মনস্থির করেন তিনিবিরহের আতিশায্যে তিনি জড় ও জীবের ভেদাভেদ জ্ঞান লুপ্ত হনতিনি মেঘকে জানাতে থাকেন,কোন কোন নগর, নদী ও পর্বত পেরিয়ে তাকে অলকায় পৌঁছতে হবেকাব্যের এই অংশে প্রাচীন ভারতের এক অসামান্য ভৌগলিক বিবরণ ফুটে উঠেছেএরপর যক্ষ কুবেরপুরী অলকা ও তাঁর বিরহী প্রিয়ার রূপলাবণ্য বর্ণনা করেছেন মেঘের নিকটঅবশেষে মেঘকে অনুরোধ করেছেন,প্রিয়তমার নিকট তাঁর কুশল সংবাদ নিবেদন করতে

     -প্রকৃতি হৃদয় ও মানব হৃদয়ের এই অপূর্ব বন্ধন কাব্যে কালিদাসই প্রথম  উন্মোচন করেনবর্ষার সঙ্গে নরনারীর বিরহবেদনার নিগূঢ় সম্পর্কের বিষয়টিকেও তিনি কাব্যজগতে প্রতিষ্ঠিত করেনযদিও ভারতীয় সাহিত্যে বর্ষার সঙ্গে বিরহের সম্পর্কের কথা কালিদাসের মেঘদূতের আগেই আমরা বাল্মিকীর রামায়ণে খুঁজে পাইকিন্তু, বাল্মিকীর রচনায় বর্ষার বাহ্যিক রূপবৈচিত্র্য বিরামহীন বর্ষণের বেগ ও ধ্বনি,প্রচণ্ড বজ্রপাত,পশুপাখিদের আনন্দ উচ্ছ্বাস ও আকাশ- ধরণীর  অবিলতা প্রভৃতির বর্ণনা খুঁজে পেলেও বর্ষার সাথে মানব হৃদয়ের গভীর সম্পর্ক ও নরনারীর হৃদয়ে বিরহবেদনায় বর্ষার আবেদন প্রভৃতির উল্ল্যেখ একেবারেই বিচ্ছিন্ন,অপরিণত ও স্থূলযেমন-

             সন্ধ্যারাগোত্থিতৈস্ত্র্যম্রৈরস্তেধপি চ পাণ্ডভঃ

              স্নিগ্ধৈরভ্রপটচ্ছেদৈর্বর্দ্ধরণমিবাম্বরম্।।

              মন্দমারুতনিশ্বাসং সান্ধ্যাচন্দনরঞ্জিতম

              আপাণ্ডুজলদং ভাতি কামাতুরমিবাম্বরম্।।

(অর্থাৎ, বর্ষার আকাশ তাম্রবর্ণের সন্ধ্যারাগ,তারই মধ্যে পাণ্ডুছায়া ও চারিদিকে স্নিগ্ধ মেঘের পটচ্ছেদে দুষ্টব্রণের বেদনা মুহ্যমান বলে মনে হচ্ছে রামচন্দ্র দেখছেন মন্দ মারুতের  নিশ্বাসে সন্ধ্যাচন্দনরঞ্জিত মেঘের ঈষৎ পাণ্ডুরতায় আকাশ যেন মিলন কামনায় বেদনাতুর হয়ে উঠেছে )

     পণ্ডিতগন অনুমান করেন যে, মেঘদূতের কাব্য পরিকল্পনায় বাল্মিকীর রামায়ণের প্রভাব রয়েছে মেঘদূতের বর্ষা কেবল ঋতু নয়, ঋতু পুরুষ কালিদাস বর্ষা প্রকৃতির যেমন বর্ণনা করেছেন,তেমনি সেই বর্ষা কেমন করে ভাবাকুল করে তোলে তারও বর্ণনা করেছেন

      কালিদাসের পর বর্ষার রূপটি আমরা জয়দেবের বর্ষা বন্দনায় দেখি কিন্তু, বাংলা সাহিত্যে বর্ষার বিচিত্র অনুভূতির জগতটি দেখতে পাই বৈষ্ণব পরকর্তাগনের পদাবলী সাহিত্যে কালিদাসের মেঘদূতের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বৈষ্ণব কবিরা বর্ষায় বিরহ ও অভিসারের পদ রচনা করেছিলেনপদাবলী সাহিত্যের একটা উল্ল্যেখযোগ্য অংশ জুড়ে রয়েছে রাধার বর্ষা অভিসারের কথা-

মেঘ-যামিনী অতি ঘন আন্ধিয়ার

    ঐছে সময়ে ধনি করু অভিসার।।

    ঝলকত দামিনী দশ দিশ আপি

    নীল বসনে ধনি সব তনু ঝাঁপি ।।’(জ্ঞানদাস)  

গগনে অব ঘন            মেহ দারুণ

           সঘনে দামিনী চমকই

    কুশিল পাতন                শবদ ঝন ঝন

           পবন খরতর বলগই

         সজনি,আজু দুরদিন ভেল ।।’ (রায়শেখর)

মন্দির-বাহির কঠিন কপাট

     চলইতে শঙ্কিল পঙ্কিল বাট।।

     তহিঁ অতি দূরতর বাদল দোল

    বারি কি বারই নীল অভিসার

    হরিবহ মানস-সুরধনী পার।।

    ঘন ঘন ঝন ঝন বজর-নিপাত

    শুনইতে শ্রবণে মরম জরি যাত ।।’( গোবিন্দদাস )

      -বৈষ্ণব কবিদের নায়ক নায়িকা বর্ষার রাতে অভিসারে বের হনআকাশে মেঘের উদয় তাদের মনে প্রিয়া বা প্রিয়তমের সঙ্গ লাভের বাসনা বাড়িয়ে দেয়নব মেঘের দল দেখে নিজ মনের কামনা বাসনার মিলনের ব্যাকুলতা শুধু পদাবলীর  বিরহীজনের নয়, জগতের সকল সুখী লোকেরওবর্ষার আগমনে গভীর বেদনাবোধ জাগ্রত হয়ে মনের সকল ভাবনাকে প্লাবিত করেবর্ষার সঙ্গে প্রেম বিরহের অটুট বন্ধন প্রোথিত হয়ে আছে পদকর্তাদের পদগুলিতে

  বড়ু চণ্ডীদাসেরশ্রীকৃষ্ণকীর্তনকাব্যে কৃষ্ণের জন্য রাধার বিরহ যন্ত্রণা বেড়ে যায় এই বর্ষা এলেইবংশীখণ্ডে কৃষ্ণের বিরহে ব্যাকুল হয়ে রাধা তার সহযোগী বড়াইকে বলেন-

                আষাঢ় শ্রাবণ মাসে মেঘ বরিষে যেহ্ন ঝর এ নয়নের পানি

                 আল বড়ায়ি

                সংপুটে প্রণাম করি বুইলোঁ সখিজনে কেহো নান্দে কাহ্নাঞিঁকে আণী ।। 

আবার দেখি রাধাবিরহ অংশে নবমেঘের গর্জন শুনে রাধা বলছেন বড়ায়িকে-

                 আসাঢ় মাসে নব মেঘ গরজএমদনে কদনে মোর নয়ন ঝুরুএ ।।

                  পাখী জাতী নহোঁ বড়ায়ি ঊড়ী জাওঁ তথাঁ

                  মোর প্রাণনাথ কাহ্নাঞিঁ বসে যথাঁ ।।

     কিন্তু বর্ষার অন্য একটি রূপ দেখতে পাই মধ্যযুগে ষোড়শ শতাব্দীতে এক বাস্তবধর্মী জীবনবাদী কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীরচণ্ডীমঙ্গলকাব্যে তিনি তাঁর কালকেতু উপাখ্যানে ফুল্লরার বারোমাসি দুঃখ কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে বর্ষার বহিরঙ্গ বর্ণনায় ফুল্লরার দুঃখকে তীব্রতর রূপে প্রকাশ করেছেন এভাবে-

                 আষাঢ়ে পূরিল মহী নবমেঘ জলবড় বড় গৃহস্থের টুটয়ে সম্বল ।।

                 মাংসের পসরা লয়্যা বুলি ঘরে ঘরেকিছু খুদ-কুড়া মিলে উদর না পূরে ।।

                 শ্রাবণে বরিষে মেঘ দিবস রজনীসিতাসিত দুই পক্ষ একই না জানি ।।

-বর্ষা কবিহৃদয় মনকে সিক্ত করে তোলে,বর্ষার নির্ঝরণীতে স্নাত উদাসী কবি স্মৃতি কাতর হয়ে পড়েনমনের অজান্তেই যেন সাজিয়ে তুলেন কবিতার একেকটি পংক্তি

 

     পাশ্চাত্য ধারণা থেকে বের হয়ে এসে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর কবিতায় বর্ষাকে এনেছেন প্রকৃতির অরূপ শক্তি হিসেবেবর্ষার প্রকৃতি আর মানব মনের প্রকৃতি এখানে মিলেমিশে একাকারযার সঙ্গে বোধকরি দেবতাগনও একাত্মতা অনুভব করেছেনবর্ষাকালকবিতায় তিনি বিম্বিত করেছেন যক্ষের বিরহী মনের বারতাযার মধ্য থেকে আমরা উত্থিত হতে দেখেছি গভীর গর্জন,নদীর উত্থাল ঢেউয়ের আছড়ে পড়া কল্লোলতা কবির বর্ণনায়-

                        গভীর গর্জনণ সদা করে জলধর,

                         উথলিল নদনদী ধরণীর উপর

                         রমণী রমণ লয়ে, সুখে কেলি করে,

                         দানবাদি দেব, যক্ষ সুখিত অন্তরে

তাছাড়াও আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্যের কবি (মূলত গীতি কবি) অক্ষয়কুমার বড়ালেরপ্রদীপ’(১৮৮৪খ্রিঃ) কাব্যগ্রন্থেরশ্রাবণেকবিতায় আমরা বৃষ্টির অনুষঙ্গ খুব সুন্দরভাবে প্রকাশিত হতে দেখি-

                     সারাদিন একখানি জলভরা শ্রান্ত মেঘ

                      রহিয়াছে ঢাকিয়া আকাশ;

                      বসিয়া গবাক্ষ-ধারে সারাদিন আছি চেয়ে

                       জীবনের আজি অবকাশ! ’

 

        -বর্ষণশ্রান্ত অলস শ্রাবণের বর্ণনা পাওয়া যায় অক্ষয়কুমারের এই কবিতাটিতেবর্ষা কেবল মানুষকে প্রেমিক বা বিরহী করে তোলে না,ভাবুক অলস যে করে তোলে তার সঠিক বর্ণনা পাওয়া যায় কবিতাটিতেতাছাড়া প্রকৃতি বর্ষার এত সুন্দর নিপুন বর্ণনা কবিতাটিকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছে,একথা পাঠকমাত্রেই জ্ঞাত

 

 

    রবীন্দ্রনাথ কালিদাস বৈষ্ণব পদকর্তাদের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তার সঙ্গে নিজস্ব কল্পজগতের রঙ মিশিয়ে বর্ষার বাহ্যিক রূপ মানব হৃদয়ের নিগূঢ় আবেদনকে কাব্যে স্থান দিয়েছেনবর্ষার কাব্যে তাই তিনিই নবশ্রষ্টারবীন্দ্রনাথ পূর্বসুরিদের ভাবচিন্তাকে বহুমূখী রূপ দান করে দিগন্ত প্রসারী করেছেন

    রবীন্দ্র কাব্যে কালিদাসের মেঘদূত বার বার এসেছেকালিদাস কাব্যের রসগ্রাহী কবি তাই তাঁর কাব্যে কালিদাসের নূতন ভাবভাষ্য রচনা করেছেনরবীন্দ্রনাথের উপর মেঘদূতের প্রভাব তাই অপরিসীমমানসীরআগে থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি কাব্যেমেঘদূতে ছায়া নানাভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেআর এই মেঘদূতকে তিনি কখনো ব্যাখ্যা করেছেন কবিতায়,কখনো গানেকিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এই ব্যাখ্যা কখনো এক হয়নি,হয়েছে ভিন্নমেঘদূত রবীন্দ্রনাথের কাছে একটি প্রাণশক্তি  রবীন্দ্রনাথ নিজের অজান্তেই তাঁর গানে মেঘদূত রচনা করে নিয়েছেন-

                  মন মোর মেঘের সঙ্গী

                    উড়ে চলে-

                    দিগ্দিগন্তের পানে

                    নিঃসীম শূন্যে

                   শ্রাবণ বর্ষণ সঙ্গীতে

                   রিমঝিম রিমঝিম রিমঝিম

      দিগন্তপ্রসারী নিঃসীমতার প্রতি আকুল গতিবেগই রবীন্দ্রমননে মেঘের পরিচয়,আর তা কালিদাসের কাব্যের মেঘ থেকেই প্রাপ্তচিত্রাকাব্যেরবিজয়িনীকবিতাটিমেঘদূতপ্রভাবিত এক উজ্জ্বল চিত্রকল্পযেমন-

                  রাজহংস দল

                     আকাশে বলাকা বাঁধি সত্বরচঞ্চল

                     ত্যাজি কোন্ দূরনদীসৈকতবিহার

                     উড়িয়া চলিতেছিল গলিতনীহার

                     কৈলাসের পানে

মনে পড়ে যায় কালিদাসের পূর্বমেঘের ১১নং শ্লোকের এই অংশটি-

       আকৈলাসাদ্বিসকিশলয়চ্ছেদপাথেয়বন্তঃ

         সম্পৎস্যন্তে নভসি ভবতো রাজহংসাঃ সহায়াঃ ।।

 

কালিদাসের মেঘদূত রবীন্দ্রনাথেনবমেঘদূতরূপে বারবার আত্মপ্রকাশ করেছেকবিগুরু বর্ষাকে  রূপ দিয়েছেন নানাভাবেতাঁর কবিতায় তাই বর্ষা কখনো বিরহিনীর বিরহ, আবার কখনো প্রিয় মানুষটিকে একান্তে কাছে পাবার আনন্দ, না বলা কথা বলার আনন্দ

       আধুনিক কবিদের মধ্যে বর্ষা নিয়ে সবথেকে বেশী কবিতা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরশিশু রবীন্দ্রনাথের প্রথম অনুভবের কবিতাজল পড়ে পাতা নড়েতারপর এই বিশ্ব-বিশ্রুত প্রতিভার অনেক মায়াবি অধ্যায় জুড়ে পাওয়া যায় বর্ষার অপরূপ কবিতা তাঁর সৃষ্টির প্রতিটি স্পর্শে বর্ষার ছোঁয়া প্রত্যেক ঋতুকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কিছু নয়া কিছু সৃষ্টিকর্ম রয়েছে, কিন্তু বর্ষা তাদের প্রথম সারিতেবর্ষা যেন কবির কাছে এক বহু কাঙ্খিত বার্তা নিয়ে এসেছেনবীন বর্ষা তাই তাঁর কাছে জীবন্ত তরণীতাই কবি বলেন-

                        আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে,

                        আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে

      এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি      পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি

                        নূতন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে

                                                               (গীতাঞ্জলি/কেতকী ১৩১৭ ,১০ই আষাঢ়)

   রবীন্দ্র কাব্য সাহিত্যে মেঘদূতের প্রভাব সীমাহীনবৃষ্টির প্রসঙ্গ বাংলা কবিতায় অনেক কবির কবিতায় হয়তো অনেকবারই এসেছে,কিন্তু কালিদাসের মেঘদূত এবং বর্ষার এক অতোপ্রোত সম্পর্ক রবীন্দ্রকাব্যেই সবথেকে বেশী ধরা দিয়েছে নিঃসন্দেহে তাঁরমানসী(১৮৯০খ্রিঃ) –‘মেঘদূত’, ‘শ্রাবণের পত্র’, ‘একাল ও সেকাল’, ‘আকাঙ্খা  , “সোনার তরী(১৮৯৪খ্রিঃ)-‘বর্ষাযাপন’, “চৈতালী(১৮৯৬খ্রিঃ)- ‘মেঘদূত’, “কল্পনার”(১৯০০খ্রিঃ)-‘স্বপ্ন’, ‘বর্ষামঙ্গল’, “ক্ষণিকা(১৯০০খ্রিঃ)- ‘সেকাল’, ‘ঝড়ের দিনে’, ‘নববর্ষা’, “গীতাঞ্জলি(১৯১০খ্রিঃ)-‘আষাঢ় সন্ধ্যাসমস্তই কালিদাসেরমেঘদূতদ্বারা গভীরভাবে প্রভাবান্বিত  তাই এইসকল কবিতাতে আমরা প্রত্যক্ষ করি দুঃখের অন্তঃস্থলে সুখের বাসএই কবিতাগুলো পাঠ মাত্রই পাঠক হৃদয়ে যেন এক অজানা স্পন্দন জেগে ওঠেএপ্রসঙ্গেমানসীকাব্যেরবর্ষার দিনেকবিতার কয়েকটি লাইন স্মরণ করা যেতে পারে-

                                 এমন দিনে তারে বলা যায়

                                এমন ঘোর ঘন বরিষায়

                            শ্রাবণ বরিষণে       একদা গৃহকোণে

                    দু কথা বলি যদি কাছে তার

                    তাহাতে আসে যাবে কিবা কার  

                                                  ( ঐশ্বর্য পর্ব-“মানসী- ‘বর্ষার দিনে)

 

      -এমন দিনেতারে বলা যায়’,এখানে কার কথা বলেছেন কবি,কোথায়ি বা তার বাস ! সেকি ঈশ্বর নাকি প্রেম নাকি নবমেঘদূত,সে জিজ্ঞাসা পাঠক মঙ্কে ভাবাকুল করে তোলেরবীন্দ্রনাথ বর্ষার বন্দনা কতভাবে যে করেছেন তার কোন শেষ নেই

 

ক্ষণিকানববর্ষাকবিতায় কবি উচ্ছ্বাস ভরে বলেছেন-

              হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে

               ময়ূরের মতো নাচেরে 

-মেঘের আগমনে কবি হৃদয় যেন চঞ্চল হয়ে উঠেছেভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে ২ আষাঢ় ১২৯৯বঙ্গাব্দ (ছিন্নপত্রাবলী) লিখিত একটি চিঠিতে কবি জানিয়েছিলেন-

       হাজার বৎসর পূর্বে কালিদাস সেই-যে আষাঢ়ের প্রথম দিনকে অভ্যর্থনা করেছিলেন এবং প্রকৃতির সেই রাজসভায় বসে  অমর ছন্দে মানবের বিরহসংগীত গেয়েছিলেন, আমার জীবনেও প্রতি বৎসরে সেই আষাঢ়ের প্রথম দিন তার সমস্ত আকাশ-জোড়া ঐশ্বর্য নিয়ে উদয় হয় সেই প্রাচীন উজ্জ্ব্যিনীর প্রাচীন কবির,সেই বহু-বহু-কালের শত শত সুখ দুঃখ বিরহ মিলনময় নরনারীদের আষাঢ়স্য প্রথম দিবস  ১০

  

        ১৮৮৬১খিঃ-১৯৪১খ্রিঃ পর্যন্ত কবির জীবনে ৮০টি আষাঢ় এসেছিলএর মধ্যে কবি জীবনের গোড়ার দিকের ২০ থেকে ২৫ টি আষাঢ় বাদ দিলে প্রতি বছরেই তিনি আষাঢ়ে গান রচনা করেছিলেনবর্ষা ছিল কবির মনোজ্ঞ গান সৃষ্টির অনুপ্রেরণা ও উৎস

     রবীন্দ্রনাথ তার বর্ষার কবিতাগুলোতে চির শ্যামল,মধুর ও বেদনারহিত চিত্র এঁকেছেনকল্পনাকাব্যেরবর্ষামঙ্গলকবিতায় নবযৌবনা বর্ষার যে রূপ আমরা পাই তা বাস্তবিকপক্ষে অপ্রাকৃত হলেও আকর্ষনীয়সেখানে আমরা দেখতে পাই, কেউ শঙ্খ বাজাচ্ছে,বধূরা উলুধ্বনি দিচ্ছে,কুঞ্জকুটিরে রমণী ভাবাকুল নয়নে বসে আছে, কেউ ভূর্জপাতায় মনের কথা লিখছে,আবার কেউ কেউ অঙ্গ প্রসাধন করছে

   রবীন্দ্র কবিতাতে বর্ষার দুটি রূপ পাওয়া যায়একটি বৃষ্টির  ঝর ঝর চঞ্চল রূপ ও বিরহের বাণী, অপরটি হল অসীম সাহসিকতা তথা শক্তির রূপএ শক্তি নির্ভীক মনের ভয়হীন কামনাতাইতো তার লেখায় ঝড়ের অভিসারিকার সন্ধান মেলেতাই কবি বলেনমানসীসেকাল ও একালকবিতায়-

                      আজিকে এমন দিনে শুধু পড়ে মনে

                        সেই দিবা-অভিসার

                         পাগলিনী রাধিকার,

                      না জানি সে কবেকার দূর বৃন্দাবনে

                   সেদিনও এমনি বায়ু রহিয়া রহিয়া-

                       এমনি অশ্রান্ত বৃষ্টি,

                       তড়িত চকিত দৃষ্টি,

                    এমনি কাতর হায় রমণীর হিয়া

-এখানে কবি বৃষ্টির অনুষঙ্গে একদিকে যেমন অসীম সাহসী রাধার অভিসারের কথা মনে করেছেন, তেমনি আবার প্রেমে পাগলিনী এক চঞ্চলা রমণীর কথাও বর্ণনা করেছেন

 

মানসীরপত্রকবিতাতে কবি বর্ষার অনুষঙ্গে মেঘদূতের কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে অভিসারিণী রাধিকার কথাওকবি বলেন-

                         বৃষ্টি-ঘেরা চারি ধার,        ঘনশ্যাম অন্ধকার,

                            ঝুপ ঝুপ শব্দ আর ঝরঝর পাতা

                      থেকে থেকে ক্ষণে ক্ষণে    গুরু গুরু গরজনে

                         মেঘদূত পড়ে মনে আষাঢ়ের গাথা

                     পড়ে মনে বরিষার          বৃন্দাবন-অভিসার,

                           একাকিনী রাধিকার চকিতচরণ- ’

    মানসীকাব্যগ্রন্থেরআকাঙ্খাকবিতায় দেখা যায়, ঘন মেঘে আকাশ ঢেকে গেছে,পূবে দমকা হাওয়া বইছেবর্ষার এই উন্মাদনার মধ্যে কবি ভাবছেন যে, সে কোথায়! আর বলছেন-

                        মনে হয় যদি পাইতাম কাছে,

                        বলিতাম হৃদয়ের যত কথা আছে

-এখানে আমাদের প্রসঙ্গতই মনে পড়ে যায় কবিশ্রেষ্ঠ কালিদাসেরমেঘদূতম্‌’ কাব্যের বিরহী যক্ষের কথা,যে অপেক্ষা করে আছে তার প্রিয়তমা পত্নীর সঙ্গলাভের জন্য,কবি হৃদয়ও একই ভাবধারায় প্লাবিত

    রবীন্দ্রনাথের উপর মেঘদূতের প্রভাবের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন তাঁরমানসীকাব্যেরমেঘদূতকবিতাটিসেখানে কবি বিরহকে সর্বকালের সর্বলোকের বিরহ হিসেবে অনুভব করেছেনআষাঢ়ের প্রথম দিনে মেঘ দেখে কালিদাস তাঁরমেঘদূতম্‌” কাব্য লিখতে শুরু করেছিলেন,তাই আষাঢ়ের প্রথম বর্ষণের সঙ্গে মেঘদূত অতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেসেই আষাঢ়ের মেঘ প্রতিবছরই যখন আসে,নতুনত্বে রসাস্বাদন ও পুরাতনকে পুঞ্জিভূত করে আসেতাই কবি বলেন-

                                   কত কাল ধরে

                             কত সঙ্গীহীন জন প্রিয়াহীন ঘরে

                             বৃষ্টিক্লান্ত বহুদীর্ঘ লুপ্ততারাশশী

                             আষাঢ় সন্ধ্যায়, ক্ষীণ দীপালোকে বসি

                             ওই ছন্দ মন্দ মন্দ করি উচ্চারণ

                             নিমগ্ন করেছে নিজ বিজনবেদন

                             সে সবার কণ্ঠস্বর কর্ণে আসে মম

                                তব কাব্য হতে

 

 

বিচিত্র প্রবন্ধগ্রন্থেরনববর্ষাপ্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ মেঘদূতের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন,তিনি বলেছেন-

    মেঘদূত ছাড়া নববর্ষার কাব্য কোন সাহিত্যে কোথাও  নাইইহাতে বর্ষার সমস্ত অন্তর্বেদনা নিত্যকালের ভাষায় লিখিত হইয়া গেছে ১১

 

        রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও বাংলা সাহিত্যের প্রাঙ্গনে প্রায় প্রত্যেক কবিই বর্ষাকে তীব্রভাবে আত্মস্থ করতে চেয়েছেনসেরকমই ভাবনা দেখা যায় বিদ্রোহী ও প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলামের মধ্যেতাঁর কবিতায়ও বর্ষা ধরা দিয়েছে বিভিন্ন প্রতিকী ব্যঞ্জনায়বর্ষার মেঘ কবির বিরহ বেদনাকে আরও একধাপ উস্কে দিয়েছেতিনি তাঁর কবিতার মাধ্যমে বাদল রাতের পাখিকে বন্ধু ভেবে বিরহের সঙ্গে নিজের বিরহ বেদনাকে একাকার করতে চেয়েছেনতিনি বর্ষাক এতাঁর দুঃখ যাতনার  সঙ্গী হিসেবে উপলব্ধি করেছেনবাদল দিনের মেঘ তাঁকেও বিরহ পাগল করেছেমেঘদূতের যক্ষের মতোতাই বর্ষাধারাকে তিনি বর্ণনা করেছেন প্রিয়তমার আগমনী বারতা হিসেবেবাদল ধারা প্রিয়তমার আগমনী সুরকে বিদায়ী সুরে পরিণত করেছেচক্রবাক’(১৩৩৬ বঙ্গাব্দ/১৯২৯ খ্রিঃ) কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গতবাদল রাতের পাখিকবিতায় কবি লিখেছেন -

                         বাদল রাতের পাখী

                         উড়ে চল যেথা আজো ঝরে জল,নাহি কফুলের ফাঁকি  

প্রিয়ার বিরহে বিরহী কবি অন্যত্র কখনো আবার গেয়ে উঠেন-

                         শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে

                          বাহিরে ঝড় বহে,নয়নে বারি ঝরে 

-বাহিরের ঝড়ের অনুষঙ্গে মূলত কবি হৃদয়ের ঝড়ের দিকটিই প্রতিভাত হয়েছেবর্হিঃপ্রকৃতি ও অন্তঃপ্রকৃতি এখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে বৃষ্টির আগমনে

  পল্লীকবি জসিমদ্দিন গ্রাম্যজীবনকে উপজীব্য  করে যেভাবে সুনিপুনভাবে বর্ষাচিত্র এঁকেছেন,তা সত্যিই অসাধারণবর্ষার উপস্থিতির জন্যই তাঁরধানক্ষেত”(১৯৩১খ্রিঃ,প্রকাশক এম্পায়ার বুক হাউস,কলকাতা)কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় কবিতাপল্লীবর্ষাপায় এক ভিন্নতর ব্যঞ্জনাশুরুটা অসাধারণ-

                           আজিকের রোদ ঘুমায়ে পড়িয়া ঘোলট-মেঘের আড়ে,

                             কেয়া-বন পথে স্বপন বুনিছে ছল ছল জল-ধারে

                           ************************************ 

              কাননের পথে লহর খেলিছে অবিরাম জলধারা

             তারি স্রোতে আজি শুকনো পাতারা ছুটিয়াছে ঘরছাড়া 

 

-জসিমদ্দিনের এই অংশটির সঙ্গেমেঘদূতের পূর্বমেঘ অংশের সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া যায়যেখানে রয়েছেবহুবিচিত্রের সহিত সৌন্দর্যের পরিচয়এবং যে পূর্বমেঘের পরিচিতি হিসেবে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন-

    মেঘ আসিয়া বাহিরে যাত্রা করিবার জন্য আহ্বান করে,তাহাই পূর্বমেঘের গান১২

---আবার পথের সৌন্দর্যে মন্থর হয়ে উঠে মনতাই আমরা কবিতাটির পরবর্তী অংশে প্রত্যক্ষ করি-

                হিজলের বন ফুলের আখরে লিখিয়া রঙিন চিঠি,

                 নিরালা বাদলে ভাসায়ে দিয়েছে নয়া জানি কোন দিঠি !

 

                কোন সে বিরল বুনো ঝাউ শাখে বুনিয়া গোলাপী শাড়ী-

                হয়তো আজিও চেয়ে আছে পথে কানন-কুমার তারি !’

-এখানে আমরা উত্তরমেঘের সেই চিরমিলনের জন্য উদ্গ্রীব মনের সাক্ষাৎ পাই, যেখানে মেঘ মিলনের আশ্বাস দেয়যাকে আমরা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে পারি-

   আমাদিগকে বৃহতের মধ্যে আহ্বান করিয়া আনেও নিভৃতের দিকে নির্দেশ করেপ্রথমে বন্ধন ছেদন করিয়া বাহির করে,পরে একটি ভূমার সহিত বাঁধিয়া দেয় ১৩

                                                             

 

 তারপর আমরা দেখি,কবি অমিয় চক্রবর্তীর কবিতায়ো বর্ষা এসেছে তবে প্রেমের প্রতীক হিসেবে নয় শুধু, নুতন প্রাণের সঞ্চারক হিসেবেঅমিয় চক্রবর্তীরপারাপার” (১৯৫৩খ্রিঃ)কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গতবৃষ্টিকবিতায় বর্ষা বিম্বিত হয়েছে নুতন রূপে,নুতন কাব্য সুষমায়কবি বলেন-

                অন্ধকার মধ্য দিনে বৃষ্টি ঝরে মনের মাটিতে

                বৃষ্টি ঝরে রুক্ষ মাঠে দিগন্তপিয়াসী মাঠে,স্তব্ধ মাঠে

                মরুময় দীর্ঘ তিয়াষার মাঠে, ঝরে বনতলে

               শিরায় শিরায় স্নানে, বৃষ্টি ঝরে মনের মাটিতে

-কবির কবিতায় বৃষ্টি অনুসঙ্গ হিসেবে মেঘদূত হয়ে না আসলেও বাহিরের প্রকৃতির সঙ্গে মনের প্রকৃতির মিল ঘটাতে চেয়েছেন বৃষ্টি যেরকম প্রকৃতিকে সৃজনশীল করে তোলে,তেমনি মানব মনেও সৃজনশীল সত্তার উদ্ঘ্বাটন করে

 

   বাংলা কবিতায় বৃষ্টি নিয়ে একাধিক কবিতা লেখা হয়েছেবৃষ্টিকে কেউ রোমাণ্টিক,কেউ উৎপীড়ক, কেউ বা বিরহের প্রতীকরুপে দেখেছেনকিন্তু সর্বোপরি বলা যায় বৃষ্টি নান্দনিক রোমাঞ্চকরকারণ, এই বৃষ্টিতেই প্রাণের গহীনে আনন্দের উচ্ছ্বাস জেগে উঠে,দেদীপ্যমান হয়ে উঠে অন্য এক অনুভুতি এবং এই বৃষ্টির ছোঁয়া হৃদয়কে করে প্রশমিত,স্বর্গীয় এক আনন্দরসের প্লাবন শুরু হয় মানব মনেআর কবিগন সেই জলস্রোত উপমা-চিত্রকল্পের মাধ্যমে আরো নিবিড়ভাবে উপহার দেন সমগ্র পাঠকসমাজকে

 

 

              ****************************************************

 তথ্যসূত্রঃ

পণ্ডিতপ্রবর তর্করত্ন শ্রীপঞ্চানন সম্পাদিতরামায়নম্‌”, চতুর্থ সংস্করণ,পৃঃ-৬১৯(কিষ্কিন্ধাকাণ্ড,অষ্টবিংশ সর্গ), ১৩১৫সাল, শ্রীনটবর চক্রবর্তী কতৃক বঙ্গবাসী ইলেক্টনিক্স প্রেস থেকে প্রকাশিত  ,কলকাতা,পশ্চিমবঙ্গ

মিত্র খগেন্দ্রনাথ,সেন সুকুমার,চৌধুরী বিশ্বপতি,চক্রবর্তী শ্যামাপদ কতৃক সম্পাদিত, “বৈষ্ণব পদাবলী”, চতুর্থ সংস্করণ, ১৯৯৯খ্রিঃ, পৃঃ-৫৫, প্রকাশক ঘোষ প্রদীপকুমার, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস  ,কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ

মিত্র খগেন্দ্রনাথ,সেন সুকুমার,চৌধুরী বিশ্বপতি,চক্রবর্তী শ্যামাপদ কতৃক সম্পাদিত, “বৈষ্ণব পদাবলী”, চতুর্থ সংস্করণ, ১৯৯৯ খ্রিঃ, পৃঃ-৫২, প্রকাশক ঘোষ প্রদীপকুমার,কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস , কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ

মিত্র খগেন্দ্রনাথ,সেন সুকুমার,চৌধুরী বিশ্বপতি,চক্রবর্তী শ্যামাপদ কতৃক সম্পাদিত, “বৈষ্ণব পদাবলী”, চতুর্থ সংস্করণ, ১৯৯৯খ্রিঃ, পৃঃ-৫৪, প্রকাশক ঘোষ প্রদীপকুমার ,কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রে , কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ

ভট্টাচার্য অমিত্রসূদন সম্পাদিত, “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”,দশম সংস্করণ, ২০০৪ খ্রিঃ,পৃঃ-৩৫৯,দেজ প্রকাশনী, কলকাতা,পশ্চিমবঙ্গ

তদেব, পৃঃ-৪২৩

নস্কর সনৎকুমার সম্পাদিত, “কবিকঙ্কন-চণ্ডী”,দ্বিতীয় সংস্করণ,দ্বিতীয় মুদ্রণ, ২০০৩ খ্রিঃ,পৃঃ-২৩, রত্নাবলী প্রকাশনী, কলকাতা,পশ্চিমবঙ্গ

দত্ত মাইকেল মধুসূদন, “মধুসূদন রচনাবলী”, প্রথম সংস্করণ,২০০৫ খ্রিঃ,পৃঃ-১৭, সাহিত্যম্  প্রকাশনী, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ

বসু বুদ্ধদেব, “কালিদাসের মেঘদূত”, পঞ্চম সংস্করণ,১৯৭৫ খ্রিঃ,পৃঃ-৭২,প্রকাশক নরাশ গুহ, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ

১০ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ, “রবীন্দ্র রচনাবলী”, একাদশ খণ্ড, ১৩৬৮ বঙ্গাব্দ,পৃঃ.৬৪-৬৫,বিশ্বভারতী প্রকাশন,কলিকাতা, পশ্চিমবঙ্গ

১১ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ, “বিচিত্র প্রবন্ধ”, তৃতীয় সংস্করণ আষাঢ় ১৩৫৫ বঙ্গাব্দ,পৃঃ-৫০,বিশ্বভারতী প্রকাশনী,কলিকাতা,পশ্চিমবঙ্গ

১২তদেব,পৃঃ-৫১

১৩তদেব,পৃ- ৫২

                                                                  

 

 

************************************************************************

                                                                   

                                                                

                                                                       

                                                                       

                                                            

No comments: