দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা ও ভাষা আন্দোলনঃ প্রসঙ্গ ত্রিপুরার বাংলা সাহিত্য
-ডঃ মীনাক্ষী পাল
সাহিত্যে প্রতিটি শাখাতেই যুগসংকটের প্রতিফলন প্রত্যক্ষ করা যায়,তা হোক গল্প-উপন্যাস,কবিতা বা নাটক। কারণ, সাহিত্যের কাজ হচ্ছে বাস্তবকে অবলম্বন করে সত্যের ভিত্তি স্থাপন করা,আর সেই বাস্তবটি হচ্ছে মানব জীবনের ঘটে চলা দ্বন্দ ও সংঘাত অর্থাৎ আত্মসংকট,আর এই আত্মসংকট যতই নিবিড় হয় সংকটের পথ ততোটাই প্রশস্ত হয়।কেননা,ব্যক্তি তার সামাজিক পরিবেশটিকে অস্বীকার করতে পারে না,সামাজিক সংকটের ঘূর্ণাবর্তে তার অন্তরের অন্তঃস্থলে যে বেদনার সৃজন হয়,তার থেকেই জন্ম নেয় একটি যুগের সংকট।
তবে সাহিত্যে আমরা সেই সংকটের চিত্র বিভিন্নভাবে প্রস্ফূটিত হতে দেখি। সেই সংকট কখনো রাজনৈতিক সংকট, কখনো ধর্মীয় সংকট,খাদ্য সংকট,ভাষার সংকট,দুর্বিক্ষ জনিত সংকট,আবার কখনো দেশভাগ বা স্বাধীনতা জনিত,কখনো উদ্বাস্তু সমস্যা জনিত সংকট।
উত্তর-পূর্বের বাংলা সাহিত্যিকরাও তাঁদের লেখায় সেই সংকটের প্রসঙ্গ বিভিন্নভাবে এনেছেন পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গের সাহিত্যিকদের মতো। উত্তর-পূর্বের ত্রিপুরা রাজ্যেও সেইসকল নানাবিধ সংকট বারবার এসেছে মানবজীবনে এবং তাকে উপজীব্য করে রচিত হয়েছে বিভিন্ন গল্প,কবিতা,উপন্যাসও।
ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতে ত্রিপুরা ছিল রাজণ্যশাসিত একটি দেশীয় রাজ্য। যেখানে আদিবাসীরা ছোটখাট পাহাড়ী যুদ্ধ,রতনমনি কতৃক বিতর্কিত রিয়াং বিদ্রোহ,রাজধানী স্থানান্তর ব্যতীত গতিহীন-মন্থর জীবনযাত্রায় অভ্যস্থ ছিল।সেখানে বৃহত্তর ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মন্বন্তর, দাঙ্গা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অস্থির রক্তাক্ত সময়ের তরঙ্গাঘাত আছড়ে পড়েনি।
১৯৪৭খ্রিঃ ৩রা জুন ব্রিটিশ সরকার চূড়ান্তভাবে ঘোষণা করেন(লর্ড মাউন্টব্যাটেনের রিপোর্ট ) যে,ভারতকে দুটো প্ররথক রাষ্ট্র তথা ভারত ও পাকিস্তানে বিভক্ত করে ১৫ই আগষ্ট ১৯৪৭খ্রিঃ ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।আর, দেশীয় রাজ্যগুলি ভারতে যোগ দেবে না পাকিস্তানে অথবা পৃথক অস্তিত্ব বজায় রাখবে সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার ছেড়ে দেওয়া হয় সব রাজ্যের নৃপতিদের উপর। সেরকম জটিল সময়েই মাত্র উনচল্লিশ বছ্র বয়সে ত্রিপুরার স্বাধীন ও শেষ রাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্যের মৃত্যু হওয়ায় ত্রিপুরার ভারত অন্তর্ভুক্তিকরণ দুবছর পিছিয়ে যায়। যদিও মৃত্যুর কয়েকদিন পূর্বেই রাজা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ত্রিপুরা ভারতভুক্ত হবে বলে এবং রাজপুত্র কীরিট বিক্রম নাবালক থাকার কারণে রাজমাতা কাঞ্চনপ্রভা দেবী ভারত সরকারকে একথা জানিয়ে ভারত সরকারের নির্দেশে কাঞ্চনপ্রভা দেবীর নেতৃত্বে কাউন্সিল অব রিজেন্সি গঠিত হয়। ত্রিপুরা রাজ্যে এটাই ছিল ব্রিটিশ সরকারের প্রথম ও শেষ হস্তক্ষেপ বা নির্দেশ । দুবভর এভাবে চলতে থাকার পর ১৯৪৯খ্রিঃ ১৫ই অক্টোবর ত্রিপুরা ভারতীয় ইউনিয়ন টেরিটরিতে যোগদান করে এবং অঙ্গরাজ্যের মর্যাদা পায়। এরই মাঝখানে ঘটে চলে ১৯৪৭খ্রিস্টাব্দের স্বাধীনতা
পরবর্তী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা জনিত কারণে পূর্ববঙ্গ থেকে বিতাড়িত হিন্দু সম্প্রদায়ের উদ্বাস্তু স্রোত সীমান্তবর্তী রাজ্য ত্রিপুরাতে সমুদ্রের সুনামীর মতো আছড়ে পড়ে এবং সেই জনস্রোতের সংখ্যা এতই বেশী ছিল যে উপজাতি জনসংখ্যার হার কমে দাঁড়ায় ৩০শতাংশে। অবশ্য সেদিন ত্রিপুরার রাজদরবার সেইসকল পূর্ববঙ্গ থেকে আগত ছিন্নমূল উদ্বাস্তুদের সানন্দে গ্রহণ করেছিলেন এবং শুধু তাই নয় ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সেই উদ্বাস্তু স্রোতের ঢল নামে ত্রিপুরাতে, যদিও তার পেছনে রাজাদের বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি চিরকালীন দুর্বলতাও ক্রিয়াশীল ছিল। ত্রিপুরা রাজ্যের উদ্বাস্তু ও আদিবাসী মিলিয়ে লক্ষ লক্ষ জনতার গনতান্ত্রিক অধিকারকে পূর্ণমর্যাদা দেবার লক্ষ্যে ১৯৭২খ্রিঃ ২১শে জানুয়ারি ত্রিপুরা রাজ্যকে ভারত রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত পূর্ণরাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে,গণতন্ত্রের সূচনা হয়।এই দীর্ঘ করেক বছরের ইতিহাস ত্রিপুরার সেই শান্ত জনজীবন অস্থির ও চঞ্চল হয়ে উঠে ।বদলে যায় ত্রিপুরার প্রেক্ষাপট।
উদ্বাস্তু স্রোতের ফলশ্রুতিতে ত্রিপুরা রাজ্যের জনজীবনকে করেছিল সেদিন বিপর্যস্ত। যার শিকার হল আদিবাসী জনজাতি বলিষ্ট ভাবে ।আদিবাসীদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানে বহিরাগত উদ্বাস্তু বাঙালি হিন্দু ভাগ বসাতে লাগল।একসময় আদিবাসীদের সহ্যসীমা অতিক্রম
করতে লাগল। জনসংখ্যার অনুপাতে ৭০শতাংশ বাঙালির চাপে পড়ে জনজাতিদের ভাষা যে বিপন্ন হতে শুরু করল,সে বিষয়ে তারা সজাগ হতে লাগল। এ প্রসঙ্গে উল্ল্যেখযোগ্য,ত্রিপুরার আদিবাসি প্রজাদের ত্রিপুরার স্বজাতীয় রাজারা দীর্ঘকাল শাসন করে এলেও আদিবাসীদের যে একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট আছে,যেমন- ভাষা,সংস্কৃতি,আচার-ব্যাবহার তার প্রতি রাজা ছিলেন সম্পূর্ণ উদাসীন। তাছাড়া রাজ আমল থেকেই আদিবাসিদের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছল্যের ব্যাপারটিও রাজার গুরুত্বের বাইরে,তখনকার সময়েও আর্থিক স্বনির্ভর অর্থনীতির আবেদনে সাহায্যপ্রার্থী হয়ে কয়েকবার আদিবাসি রিয়াং সম্প্রদায় ব্যর্থ হয় বলে জানা যায়।
বিপরীতে,ত্রিপুরায় যাবতীয় রাজকার্যের মাধ্যম ছিল বাংলা ভাষা। ফলে,সবকিছুই চলত বাংলা ভাষাতেই। আর যার ফলে আদিবাসীদের ঘরে-বাইরে বাংলা ভাষার প্রচলন হতে হতে একসময় তারা মাতৃভাষাকে হারিয়ে ফেলতে বসেছিল। তাদের ঘরের শিশুপুত্ররাও নিজের মাতৃ ভাষার বদলে বাংলা ভাষাতেই মুখের প্রথম বুলি ফোটায়। কিন্তু রাজ আমলের অন্তিম পর্বে নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতির প্রতি ত্রিপুরার আদিবাসি জনসমাজ ক্রমশ সজাগ হতে লাগল,তারা তাদের ভাষার প্রতি কৌতুহলী হতে লাগল এবং রাজন্য বর্গের উদাসীনতার বিপক্ষে তাদের মনে দানা বাঁধতে লাগল। তাই রাজন্যপর্বের শেষ দিকে একটা অশান্ত পরিস্থিতি লক্ষ্য করা যায় ,যার ফলেই বৃহত্তর ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে ত্রিপুরার সীমা নির্ধারিত হল।
আগে যেখানে রাজা ও রাজধানীকে কেন্দ্র করে মানুষ তাদের সুখ-দুঃখ ভাগ করতে পারত,এখন সে জায়গা হয়ে উঠল কেবল অঙ্গরাজ্যের রাজধানী ।আন্তরিকতার ছোঁয়া সেখানে অনুপস্থিত। ফলত, আদিবাসীদের বিচ্ছিন্নতা প্রকট হতে লাগল। তাদের হৃদয় যন্ত্রণা অকপটে অনুচ্চারিত রয়ে গেল । আদিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতির ক্রমশ বিলুপ্তির এমনই একটি যন্ত্রণাদগ্ধ আখ্যান হয়ে রইল মানস দেববর্মণের ‘দশ টাকা পাঁচ টাকার গল্প’(১৯৮৬ খ্রিঃ, পৌণমী প্রকাশন) গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘স্বপ্নে তব কুললক্ষী’ গল্পটি যা ত্রিপুরার আদিবাসী জনসমাজের হারিয়ে যাওয়া অস্তিত্বের প্রতি স্পষ্ট আলোকপাত
করে ত্রিপুরার গল্প সাহিত্যের জগতে স্বতন্ত্র মাত্রা যোগ করেছে।
গল্পের নায়ক শহরবাসী যুবক সৌগত ,সে ত্রিপুরী সম্প্রদায়ের । কিন্তু বাল্যকাল থেকেই সে বাংলা ভাষার মাধ্যমেই পড়াশুনা করেছে,এমনকি তার বাবা রাধাচরণ উদয়পুরে সোনামুড়া অঞ্চলে কাজ করার সুবাদে মাতৃ ভাষা জানে না । শুধু তাই নয়, রবীন্দ্রনাথ ও ত্রিপুরা সম্পর্কের স্মৃতি আকড়ে ধরে গভীর আত্মসন্তুষ্টি পান। সৌগতের বাঙালি বন্ধু ঝন্টুকে ত্রিপুরায় রবীন্দ্র সম্বোর্ধনার জমায়েতের ছবিতে নিজেকে চিহ্নিত করে তিনি দেখান ও বলেন যে, বাংলাদেশে বাংলা ভাষা রাষ্টীয় ভাষা রূপে
স্বীকৃতি পাওয়ার পূর্ব থেকেই ত্রিপুরায় রাজভাষা ছিল বাংলা এবং সেটা বোধকরি তার গর্বের বিষয় হিসেবেই বলতে চেয়েছেন।
এরকমই একটি বাঙালি পরিবেশে বেড়ে ওঠা সৌগত চাকুরির ফর্ম ফিলাপ করার সময় মাতৃভাষার কলামে তার বাবা রাধাচরণ বাংলা
লেখতে বলেন,কারণ ত্রিপুরী হওয়া স্বত্ত্বেও সে ককবরক জানে না । আর এই না জানার মধ্যেও কোন লজ্জা খুঁজে পান না সৌগতের বাবা। কিন্তু সৌগত তার মাতৃভাষা শিখতে চায় এবং একথা তার বন্ধুদেরও জানায়।তাছাড়া বন্ধুদের সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে আসে পাহাড়ী বাঙালির বৈবাহিক সম্পর্কের কথাটিও।শুধু তাই নয়,আদিবাসি বাঙালির আত্মিক সম্পর্কের দিকটিও প্রতিভাত হয় এখানে।
সৌগত বিচারবুদ্ধিহীন অবিবেচক নয়, সে জানে তালি কখনো এক হাতে বাজে না ।সে ত্রিপুরায় বাংলা ভাষার একাধিপত্য বিস্তারের পিছনে রাজন্য ত্রিপুরার নৃপতিদেরই দায়ী করে।সেই সঙ্গে আদিবাসী সমাজের শিক্ষিত সম্প্রদায় নিজস্ব তাগিদে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকার জন্য তখনকার রাজার সেই সিদ্ধান্তকে মাথা পেতে নিতে হয়। গল্পে আমরা এটাও দেখি যে, শহরে বসবাসকারী আদিবাসীরা মাতৃভাষা না জানলেও বনের পাখী ময়না যে কিনা সৌগতের মাসীর বাড়িতে পালিত সে ককবরক জানে।
তারপর আমরা যা দেখতে পাই তা বোধকরি সৌগতের মনে সবথেকে বড় দাগ কাটে ও লজ্জার অনুভূতি জাগায় ।যখন সৌগত পূর্বে আবেদন করা চাকুরির ইণ্টারভিউ দিতে যায়,সেখানে তাকে জিজ্ঞেস করা হয় তার মাতৃভাষা কি,সে উত্তরটা সোজাসাপটা না দিয়ে ঘুরিয়ে দেয়। সে বলে-
“আমরা বাংলায় কথা বলি ।” ১
কিন্তু তার উত্তরে সন্তুষ্ট না হয়ে পুনর্বার প্রশ্ন করা হয় এবং ঘরময় একটা হাসির চাপা রেশ ভেসে উঠতে দেখে সে। তারপর তাকে যখন জিজ্ঞেস করা হয় মাতৃভাষা জানে কিনা,উত্তরে সে বলে শিখবে তার মেসো মশাইয়ের কাছ থেকে।
সে আরেকটি বিষয় ইণ্টারভিউ দিতে ঘিয়ে লক্ষ্য করে,ইণ্টারভিউ বোর্ডে তারই এক দুর্সম্পকীয় কাকা যোগ্যতা বলে সেদিন সেখানে ছিলেন।যদিও নিজ প্রচেষ্ঠা ও মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা ও কৌতুহলবসে সৌগত পরে তার মাতৃ ভাষাটি আয়ত্ব করে নেয়।
-গল্পটিতে লেখক সমাজ-সংস্কারের মতো সৌগতকে মাধ্যম করে ত্রিপুরার আদিবাসি জনগনের ভাষার সংকটের মুহূর্তটিকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন নিপুনতার সঙ্গে ।গল্পের শেষের দিকে মেসোমশাইয়ের প্রতি সৌগত যখন বলে-
“আন নিনি অর বুলাঙগই যাংদি আং আরণ তংণানি।” ২
(-অর্থাৎ আমাকে তোমার কাছে নিয়ে চল না, আমি ওখানেই থাকব।) –তখন সর্বকালের সর্বদেশের অস্তিত্ব সংকট ও ভাষা সংকটের প্রতি পাঠকে সজাগ করে তোলে।প্রসঙ্গত আরেকটি কথা উল্ল্যেখ করতেই হয় যে,গল্পকার মানস দেববর্মণও কিন্তু সেই সৌগতের সম্প্রদায়ভুক্ত। তাই এই গল্প তার বাস্তব জীবনের অন্তর্দহনের চিত্র হতে পারে অনুমেয়।
দেশভাগের ফলশ্রুতিতে যে উদ্বাস্তুর ঢল নামে ত্রিপুরার মাটিতে ,তাতে শুধু ভাষার সংকটই নয় অস্তিত্বের সংকটে জর্জরিত হতে হয় পাহাড়ি ও বাঙালি দুই সম্প্রদায়কে । একদা যে ছিন্নমূল বাঙালি উদ্বাস্তুকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিল অপেক্ষাকৃত অনুন্নত উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ, গড়ে উঠেছিল অপূর্ব মেল বন্ধন ও পরম আত্মীয়তা, এমনকি বিবাহের মতোও সামাজিক স্বীকৃতি সেই মধুরতম সম্পর্কের মধ্যে
আগুন ধরিয়ে দিয়ে তার লেলিহান শিখায় উদ্যম নৃত্যে উদ্গ্রীব হয়ে উঠে কিছু সুবিধালোভী মানুষ সাম্প্রদায়িক কার্যকলাপে লিপ্ত হয় ও একসময় ঘটনা এরকমই চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় যে, নিজের ভিটেমাটি থেকেও বাঙালি আরেকবার ছিন্নমূলের যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়,সেইসঙ্গে নিজের স্বাধীন রাজ্যে বসবাস করেও পাহাড়ীরা নিজেকে শরণার্থী ভাবতে বাধ্য হয়। দুই সম্প্রদায়েরই পায়ের তলার মাটি সেদিন সরে যেতে লাগে ।এরকমই একটি বাস্তব ঘটনার সাক্ষী হয়ে রচিত হয় জহর দেবনাথের “ধলাইপারের রূপকথা”(২২০২খ্রিঃ,ভাষা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ) গ্রন্থের দ্বিতীয় গল্প ‘আগুন-নদীর তীরে ।’
গল্পটির শুরুতেই দেখতে পাওয়া যায় বাঙালি বৃদ্ধ নিবারণ এবং পাহাড়ি আদিবাসি জীবেশ সাংমাকে । সেইসঙ্গে দেখা যায় ঘরে ঘরে আসন্ন পৌষপার্বণের প্রস্তুতি এবং শনিপূজার চিত্র।সেই শনিপূজার প্রচলন সম্পর্কে ধারণা নয়া থেকলেও অবিভক্ত বাংলার সিলেট জেলার বাড়ীতেও বৃদ্ধ নিবারণ দেখেছেন এই শনিপূজার প্রচলন বাল্যকাল থেকেই। সেই ধারা প্রচলিত পরবর্তীকালে পার্বত্য ত্রিপুরার ধলাই পাড়ের বলরাম পাড়ায়।
সেই নিবারণের বাবা পূর্ব-পাকিস্তান থেকে একসময় ধর্মীয় দাঙ্গায় বিতাড়িত হয়ে ধলাইপারের বলরামের সাংমা বস্তীর প্রাচীন বাসিন্দা জীবেশ সাংমার বাবার কাছ থেকে কিছু জমি জায়গা কিনে অনাবাদী জংলা জায়গাকে আবাদযোগ্য করে স্ত্রী-সন্তান সহ বসবাস শুরু করেন । সেই থেকে নিবারণ ও জীবেশ বন্ধু। নিবারণদের দেখাদেখি জীবেশরাও অনাবাদী জংলা জলাভূমিকে পরিস্কার করে সোনার ফসল ফলিয়েছে। আবার নিবারণেরাও শূয়র ,মোরগ,এমনকি গুদকের মতো খাবার পাহাড়ি বন্ধুদের থেকে রপ্ত করেছে।
তাছাড়াও পাহাড়ী খাবার ও পানীয় ঝলসানো শূয়র আর চূয়াকের স্বাদও নিবারণদের সান্নিধ্যে শিখেছে। একসঙ্গে লঙতরাইয়ের পাদদেশে টংঘরে যে তাদের কত
সময় কেটেছে,তা যতই ভাবে ততই মধুর লাগে। নিবারণদের অবলম্বন করে পরে অনেক বাঙালি পরিবারো আসে,সবাইকে সাদরে বুকে টেনে নেয়। কিন্তু অনেককাল পর তাদের মা-বাবা ইহলোক ত্যাগ করলে তাদেরই সংসারের হাল ধরতে হয়।
শনিপূজা থেকে শ্মসান যাত্রা,এরা পাহাড়ি-বাঙালি কাঁধে কাঁধ রেখে চলেছে। উত্তর পাড়ার গোবিন্দ বিশ্বাসের ছেলে মাধব আর পূর্ব পাড়ার গোপেশ সাংমার মেয়ে অনিতার বিয়েতেও সবাই প্রথমে একটু আপত্তি দেখালেও শেষে উভয় সম্প্রদায় একসঙ্গে বিবাহ ভোজের আমন্ত্রণে সামিল হয়।
শান্তিপূর্ণ তৎকালীন ত্রিপুরার পরিস্থিতির মধ্যে হঠাৎ দেখা গেল সন্ত্রাসের ধোঁয়া ত্রিপুরার আকাশকে অন্ধকার করতে শুরু করল।একদল সন্ত্রাসী গ্রামে ঢুকে বাঙালি বিরেন দেবনাথের মাথায় বন্ধুক ঠেকিয়ে নিয়ে চলে যায় তাকে এবং তার স্ত্রী মমতা বাধা দিতে গেলে তাকে পায়ে গুলি করে রক্তাক্ত করে রেখে চলে যায় ।যাওয়ার সময় আরো কিছু বাঙালি বাড়ি-ঘরে আগুন দিয়ে যায়। অপরদিকে,একদল পাহাড়ি উত্তেজিত যুবক দুষ্কৃতিকারীদের সাহায্য করে ও কিছু পাহাড়ি বাড়িতেও সেদিন আগুন ধরিয়ে দেয় সন্ত্রাস সৃষ্টির জন্য। এভাবে চলতে চলতেএকসময় সন্ত্রাসের দাবানলে পুড়ে ছাই হয়ে যায় বলরাম পাড়ার মিশ্র জনবসতি,যদিও চক্রান্তকারীদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে পূর্বাভাস পেয়েছিলেন গ্রামের বৃদ্ধ-প্রৌঢ়রা এবং কয়েকবার মিটিং ডেকে কমবয়সী পাহাড়ি যুবকদের অর্থের লোভে সে পথে পা না বাড়ানোর সুপরামর্শও দিয়েছিলেন। বলেছিলেন-
“দেখ হে বাপু তোমাদের জন্মের অনেক আগে থেকেই এখানে আমরা সবাই একে অন্যের বন্ধু হিসাবে বাস করে আসছি। আমাদের সেই বন্ধুত্বকে তোমরা রক্ত দিয়ে কলংকিত করো না।” ৩
-কিন্তু কেউ কারো কথা শুনেনি। পাহাড়ি-বাঙালির সন্ত্রাসে সব যখন পুঁড়ে ছাই হয়ে গেল,তখন বৃদ্ধ নিবারণ ও জীবেশ একে অপরকে জড়িয়ে ধরে সহায়সম্বলহীন শরণার্থী হয় একই আকাশের নিচে, ধলাই নদীর শীতল জল সেদিন প্রবহমান ।
দেশভাগ এবং উদ্বাস্তু স্রোত সেদিন ত্রিপুরার শান্ত নিরবিচ্ছিন্ন জীবনে সন্ত্রাসে বীজ যেভেবে বপন করেছিল ও অলট পালট করে দিয়েছিল স্বাভাবিক জনজীবন তা বোধকরি
জহর দেবনাথ স্পষ্টতই বোঝাতে চেয়েছেন গল্পটিতে,তাই তখনকার ত্রিপুরার বাস্তব দলিল তার এই গল্পটি নিসঃন্দেহে।
দেশভাগের বাস্তব রূপ ফুটে উঠে প্রদীপ সরকারের ‘ছিপ’(২০০৬খ্রিঃ,ভাষা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত) গল্পগ্রন্থের ‘কাঁটাতারের সীমান’ গল্পটিতে। যে আসিফ ও সামিন ছোটবেলা থেকেই একই বিলে নেমে পদ্ম তুলত,দেশভাগ তাদের জীবনকে দুভাগ করে দিয়েছে।শুধু তাই নয়,সেই বিলের জলো আজ দ্বিধা বিভক্ত।সে প্রসঙ্গে লেখক বৃদ্ধ জেলের জবানীতে বলেন-
“আইচ্ছা কন কর্তা,জল আর মাইন্ষের ভালবাসারে বেড়া দিয়া আটকাইয়া রাখন যায় ? মুরুব্বিরা কইত এতে নাকি বিপত্তি ঘটে।” ৪
সেই মেয়ে সামিনের খঁজে এক বৃদ্ধ চিত্র সাংবাদিক দামি ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে সেই বিলপারে উপস্থিত হন মেয়েটিকে পুরস্কৃত করবেন বলে । কারণ, যে মেয়েটির পদ্মের বোঝা সমেত ফটো সংগ্রহ করে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছিলেন তাকে নিজে পুরস্কৃত করার তাগিদ অনুভব করেন এবং সেই তাগিদেই তার নাজির বিলে আসা। কিন্তু, বর্তমানে কাঁটাতারে বিভক্ত নাজির বিলের সেই ছোট্ট সামিন আজ বড় হয়ে গেছে,কিন্তু সে এখন অপর পারের বাসিন্দা ।কাঁটাতার তাকে আর তার ভালিবাসার সঙ্গী বাল্যবন্ধু আসিফকে আলাদা করে দিয়েছে,দুজন এখন দুপারের বাসিন্দা।আসিফের সঙ্গে মিলতে ও পদ্ম কুড়তে এখন আর তারা পারে নয়া ,অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে আছে সেই কাঁটাতারের বেড়া ।এরকম দ্বিধাবিভক্ত নাজির বিলের বাসিন্দা সামিনের দেখা করতে আসা চিত্র সাংবাদিক দেখা পান তার অনেক অপেক্ষার পর,সংবাদের শিরোনাম দেখে।শিরোনামটি এরকম-
“সীমান্তরক্ষীর গুলিতে দুই পাচারকারী মৃত”। ৫
-সঙ্গে সঙ্গে নাজির পারে ভিড় জমে অফিসার,সাংবাদিক,এলাকাবাসীর ও। সেই চিত্র-সাংবাদিকও সামিল হন সেই ভিড়ে,তবে তার ক্যামেরার শাটারটি খট্ করে বন্ধ হয়ে গেল। সেদিন সামিনের মুখ বৃন্তচ্যুত পদ্মের মতো দেখাচ্ছিল। ভালবাসার মানুষ বাল্যবন্ধু আসিফের সঙ্গে ঘর বাঁধার স্বপ্ন নিয়েই সে পাড়ি দিয়েছিল নাজির বিলের অপরপারে, কিন্তু সীমান্তরক্ষীর চোখে পাচারকারী রূপে চিহ্নিত হয়ে মৃত্যুর কাছে প্রাণ সঁপে দেয় সে। যে বিলে তার দেহ ভেসে উঠছে,সেই বিলেই সে একদিন স্বাধীনভাবে পদ্ম কুড়িয়েছিল আসিফের জন্য। কিন্তু আজ সেই কাঁটাতার তার স্বাধীনতার সঙ্গে প্রাণটাও কেড়ে নিল। দেশভাগ তৎকালীন ত্রিপুরায় উদ্বাস্তুদের জীবনে অভিশাপ হয়ে এভাবেই হয়ত অনেকেরই প্রাণ কেঁড়ে নিয়েছিল।
গল্প ছাড়াও যদি আমরা কবিতার দিকে দৃষ্টি
দেই,তাহলে সেখানেও দেখবো দেশভাগ জনিত এক বিপন্ন বিস্ময়ের প্রতিচ্ছবি। সুধীর সরকারের “অবোধবেলা”( ২০০১খ্রিঃ,মনোবীজ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত) কাব্যগ্রন্থের ‘সাতচল্লিশ’ নামক কবিতাতেও খুব সাবলীল ভাবে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন দেশভাগের যন্ত্রণার কথা। কবিতাটির কয়েকটি পংক্তি এখানে তুলে ধরা হল-
“ ৪৭ আমার পিছু ছাড়ে না, ৪৭ আমাকে শান্তি দেয় না।
৪৭ আমাকে প্রথম নির্যাতন আর নাজেহাল করে মর্কট-নির্বাচন সভায়-
অর্থাৎ ৬৫র ইস্কুলের শেষতম পরীক্ষায় ।” ৬
পরক্ষণেই আবার তিনি বলেন-
“৬৫ এ আমার সামনে মুকুন্দ বাবুর প্রশ্ন ছিল খুবই কঠিন প্রশ্ন,
স্বাধীন ভারিতের জনক কে বলিতে পার?
আমার চাঁছাছোলা জবাব ছিল,স্বাধীন ভারত অনাথ,শুধু অনাথই নয়-
ব্যাভিচারের ফলে স্বাধীন ভারতের জন্ম,তাই সে জারজও।
৪৭এ আমার মুকুলগ্রাম ছেড়ে স্বাধীন ভারতে পালিয়ে আসার পথে
রেললাইনের পাশে আমাকে জন্ম দেন।
আমিও অনাথ, তবে জারজ নই।” ৭
-সেই দেশভাগ ও স্বাধীনতা প্রকৃত অর্থে কি স্বাধীনতা দিতে পেরেছিল সেদিনকার ভারতবাসীদের,পারলেও কতখানি সে প্রশ্ন থেকেই যায়।সেই দেশভাগ জনিত স্বাধীনতা মানুষকে যেমন দিয়েছে,নিয়েছেও কেঁড়ে অনেক কিছু।বাস্তুহারা মানুষ নিজের অস্তিত্বকেও হারিয়ে ফেলেছিল রাজনৈতিক টানাপোড়েনের ফলে।হারিয়ে ফেলেছিল নিজের পরিচয়। ত্রিপুরার স্পষ্টবাদী কবি নির্বিঘ্ন চিত্তে এসকল কথাই বারংবার বলতে চেয়েছেন কবিতাটির মাধ্যমে।দেশভাগের সেই যন্ত্রণা বুকে চেপে রেখেছিলেন ত্রিপুরার জনগনও, যা কবির কবিতায় বাঙ্ময় হয়ে উঠে।
দেশবিভাগ পরবর্তী ত্রিপুরার জনগন প্রত্যক্ষ করেছেন স্বাধীন শান্তিপূর্ণ ত্রিপুরা রাজ্য, তারপর অঙ্গরাজ্য,তারপর পূর্ণমর্যাদা প্রাপ্ত ভারতীয় রাজ্য, অন্তরে রাজদ্রোহ, জনশিক্ষা আন্দোলন, রিফিউজি ঢল, বাসস্থানের সংকট, আদিবাসী বাঙালির
সাম্প্রদায়িকতা ও যার ফলস্বরূপ ১৯৮০ এর মান্দাই হত্যাকাণ্ড-এসকল ঘটনা তখন ত্রিপুরার জনগনের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। আর সেই ঘোর কাটাতে অনেকটাই সময় লেগেছিল ত্রিপুরার জনগনের । তাই সাহিত্যে তার ছাপ গল্প-কবিতাতে পেলেও উপন্যাসে অনেকটাই পরে পাওয়া যায় এবং
যেটুকু পাওয়া যায় তা বিছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। যেমন- দুলাল ঘোষের ‘অগ্নিসূত্র’, নন্দকুমার দেববর্মার – ‘ঠিকানা কিরাতভূমি’, উপন্যাসে ঘটনা প্রসঙ্গে দেশভাগ এসে থাকলেও দেশভাগ জনিত সংকট মূল বিষয় হয়ে উঠেনি ।
ঠিকানা কিরাতভূমি উপন্যাসে গোবিন্দের মামা মরণ মাঝিকে আক্ষেপ করতে দেখা যায় পূর্ববঙ্গের স্মৃতি মনে পড়লে। পেশায় মাঝি হওয়ার দরুণ সে নৌকা দিয়ে গোমতী নদীতে লোক পারাপার করে । একদিন তার ভাগ্নে গোবিন্দ যখন তাকে বাংলাদেশে যেতে ইচ্ছে প্রকাশ করে কারণ সে শুনেছে এই গোমতী নদীই নাকি বাংলাদেশে গেছে এবং শুধু তাই নয় অনেকবার গোমতীর এপার অর্থাৎ কসবা দিঘির পাড় থেকে সে বাংলাদেশও দেখেছে বলে জানায়। গোবিন্দের বাংলাদেশ সম্পর্কে কৌতুহল দেখে মরণ মাঝি পূর্ববঙ্গের প্রতি নস্টালজিক হয়ে পড়ে। তখন সে বলে-
“কোন দেশডারে ফালাইয়া আইছি জানস না , বেটা জানস না। তর তো এহানেই জন্ম । তুই বুঝতি না।” ৮
মরণ মাঝির অবিভক্ত ভারতের বাসিন্দা ছিল, দেশভাগের ফলে সে এপার অর্থাৎ ত্রিপুরায় আসে যদিও কিন্তু মনটা তার সব সময় কাঁদে জন্মস্থানের জন্য। দেশভাগ সেদিন মরণমাঝির ন্যায় আর সহস্র জনগনকে ছিন্নমূল করেছিল, করেছিল স্বজনহারাও।
মরণমাঝির মতো আমরা নস্টালজিক হতে দেখি প্রতিমা শিল্পী নিতাই পালকেও। নিজের দেশ ছেড়ে যে দেশের বাসিন্দা হয়েছে সেখানেও যেন নিতাই পাল অসহায় বোধ করছে। কারণ, ত্রিপুরা সেদিন আর শান্ত ছিল না, কিছু সংখ্যক বিপথে পরিচালিত ত্রিপুরী যুবকদের উগ্রবাদী কাণ্ডকলাপে ত্রিপুরার শান্ত জীবন বিঘ্নিত। এমত পরিস্থিতিতে সববাস করে প্রতিমা শিল্পী নিতাই পাল পূর্ববঙ্গের কোন এক সময়ের শান্ত জীবন যাত্রাকে গভীর ভাবে উপলব্ধি করে স্মৃতি রোমন্থনের মাধ্যমে, আসন্ন পূজার জন্য প্রস্তুত প্রতিমার গায়ে রঙ দিতে দিতে সম্পর্কীত নাতি গোবিন্দের উদ্দেশ্যে-
“আর ভালোর দিন কি আছে দাদু।…ভরা গাঙে নাও বোঝাই হাড়ি পাতিল কলস লইয়া বাজার যাইতাম উজানে নাও বোঝাই নারকেল লইয়া বাড়ীও ফিরতাম সাইনাজাবেলা। পূজা মাইয়ার দিন আইলেই মনটা চাঙ্গা অইয়া উঠতো। নিজেরার বাড়ীত নিজেরাই ঠাকুর বানাইয়া পুজা দিতাম। মায়ের মূর্তি বানাইয়া পেট চালানোর কথা ভাবতামই না ? হেই দিনকাল গেছে গা ।”৯
- একথা শুনে গোবিন্দের মনে পড়ে যায় পরান মামার কথা,তার মনে পূর্ববঙ্গ সম্পর্কে এক অলীক কল্পনার জগত ডানা মেলে। ছোটবেলা গোবিন্দ তার বাবার মুখে শুনেছে,তার বাবা নাকি তাড়া খেয়ে ১৯৫৮ খ্রিঃ ত্রিপুরায় আসেন, তার মাও সেই একই গল্প বলতেন। রিফুজী কার্ড এখনো আছে গোবিন্দদের,তার বাবা যত্ন করে রেখেছিলেন।
নন্দকুমারের উপন্যাসে দেশভাগ,উদ্বাস্তু সমস্যা প্রক্ষিপ্তভাবে এলেও
বিমল সিংহের ‘তিতাস থেকে ত্রিপুরা’ উপন্যাসে দেশভাগ ও উদ্বাস্তু সমস্যা
একটি বিশাল জায়গা জুড়ে রয়েছে।ঔপন্যাসিক বিমল সিংহ তাঁর উপন্যাসে দেখিয়েছেন দেশভাগের ফলে মূল ভূখণ্ড থেকে বিছিন্ন জনগনের জীবন যাত্রার নানান সুখ-দুঃখের কাহিনী । উপন্যাসের মুখ্যা চরিত্র মাখন তিতাস পারের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রসুলপুর গ্রামের ব্রাহ্মণ বসন্ত ঠাকুরের ছেলে। পরপর দুইবার বন্যার ফলে দুবিক্ষ দেখা দিলে পেটের তাগিদে তখন সকলে দেশ ছেড়ে ত্রিপুরায় পাড়ি দেয় ।শুধু দুর্বিক্ষই নয়, ওলাওঠা,আমাশয়ে কত লোকের যে প্রাণ গেছে তার হিসেব নেই। একদিকে দেশভাগ , অপরদিকে দুর্বিক্ষ ও মহামারি তিতাস পারের বাসিন্দাদের নাজেহাল করে তোলে, বাঁচার উপায়স্বরূপ তারা দেশত্যাগকেই বেছে নেয়। এরকম পরিস্থিতিতে মানুষের পূজার্চনার যেখানে প্রশ্নই উঠে না, সেখানে মাখন ঠাকুরের চোখের সামনে ঘোর অন্ধকার নামে পেটের চিন্তায়। ব্রাহ্মণ সন্তান, লাঙল ধরাও তার বারণ। তাই ভিক্ষেই তার সম্বল। একসময় তাতে করে বৃদ্ধ মার মুখে খাওয়া জোগানো দুস্কর হয়ে পড়ে, শেষ পর্যন্ত মাখনের মাসতুতো ভাই ত্রিপুরার খোয়াই মহকুমায় একটি বেসরকারী স্কুলে একটা মাস্টারি চাকরির খবর দেয়, যদিও মাইনে নিতান্তই কম, তবুও অনাহারে থাকার চেয়ে সেটাকে শ্রেয় বলে ভেবে নিয়ে মায়ের হাত ধরে সেও পাড়ি দেয় ত্রিপুরা রাজ্যে। সেখানে পাহাড়িরা তাকে আপন করে নেয়। ছাত্র পড়িয়ে , উপরন্তু যজমানি করে নিজের জায়গাটা করে নিতে পারে সে। কিন্তু সেখানে এসে সহজ সরল পাহাড়ি আদিবাসীদের কিছু প্রতারক বাঙালী উদ্বাস্তু মহাজনদের দ্বারা দাদন নেওয়ার নামে জোর জবরদস্তি জমি দখল করে ভেটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করার ঘটনা তার মনে দাগ কাটে। পাহাড়ী বৈশরায় যার শিকার, গোপাল ঘোষ তার জমি সাদা কাগজে সাক্ষর করিয়ে নিজের নামে করে নিয়েছে। মহাজনদের এই চেহারা তার কাছে নতুন নয়, দেশেও সে দেখে এসেছে সহজ সরল মানুষদের মহাজনদের ফাঁদে পা দিতে। আগাম ঋণ দিয়ে সেখানেও মহাজনেরা চাষী-জেলেদের ঠকাতো। অভাবের তাড়নারয় কেউ জমি বন্ধক দিত, কেউ ঘরের গরু বিক্রী করতে বাধ্য হত মহাজনের ঋণের বোঝা মেটাতে। এমনকি তাদের ঘরের মহিলাদের উপরও চালাত শারীরিক যৌন অত্যাচার ।নুতন দেশে এসে বিচিত্র পৃথিবীর কাণ্ডকলাপের কথা ভেবে সে মর্মাহত হয়। সে ভাবে-
“দেশ হারানোর জ্বালা এখনো ধিক ধিক জ্বলছে মনের দিক দিগন্ত জুড়ে। একই যাতনা বৈশারায়ের মনে জুমের আগুন হয়ে কি জ্বলে না। ভিটে মাটি ছাড়ার
দুঃখবোধ পাহাড়ী হোক বাঙালী হোক কারো বুকে শূন্য হাহাকার না উঠে পারে না ।” ১০
প্রসঙ্গত উল্ল্যেখ্য, দেশভাগ পরবর্তী উদ্বাস্তু স্রোত
সেদিন ত্রিপুরার সহজ সরল পাহাড়ী জনজাতিদের অনেক ঠকিয়েছিল। ধান বেপারীরা ধান কিনতে তিতাস পার থেকে ত্রিপুরায় যেত এবং পাহাড়িদের ঠকিয়ে চার পোয়া মাপতে ছয় পোয়া মেপে নিয়ে আসত পাহাড়ীদের অন্ধ বিশ্বাসের জন্য, কারণ পাহাড়ীরা অবিশ্বাস কি জিনিষ জানতই না, তাই তারা ধান মাপার ও কেনার জন্য তিতাস পারের বেপারীদের উপর চোখ বুজে বিশ্বাস করত। কেউ আবার পাহাড়ীদের ঠকিয়ে কার্পাস তুলাও আনত। কেঊ বা নানারকম প্রসাধণ সামগ্রী ও মেয়েদের পুতির মালা, চুড়ি, চিরুণীর ব্যাবসা করত। যারা বুদ্ধিমান তারা জায়গা জমিও কিনত কম দামে পাহাড়ীদের থেকে। যে পাহাড়ীরা উদ্বাস্তু বাঙালীদের আপন করে নিয়ে একসময় জায়গা করে দিয়েছিল, সেই পাহাড়ীরাই আবার ছিন্নমূল হয় সেই সকল উদ্বাস্তু প্রতারক বাঙালী মহাজনদের দ্বারা। গোবিন্দের মা তাই বলে-
“দেশেও ইতানের জ্বালায় মরছি। ইখানো আয়াও হেরার স্বভাব যাইত না । তিপরারা যদি জাগা না দিত তাইলে খাইত কি। হের লাইগ্যা আওনের সময় পুজার দিন, রাজারামে কইছিল বাঙালির মধ্যে খারাপ মানুষ আছে, তারার লগে চইল্য না । বাবারে বৈশারায়ের চোখের পানি এমনে যাইত না । সুদ খওন্যা হগল বুঝব, যেদিন ঠাকুর বিচার করব। এই রকম ধর্ম ডাকাতি কইর্যা কয়দিন চলবে, ঠাকুরে ঠিকই দেখে ।” ১১
দেশবিভাজন ও তৎপরবর্তী উদ্বাস্তু স্রোত ত্রিপুরার শান্ত নির্বিঘ্ন জনজীবনকে সেদিন বিভিন্ন সংকটের মুখোমুখী এনে দাঁড় করিয়েছিল। সেই স্রোতের প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল পাহাড়ী জনজাতি, চিরকালীন সহজসরল আস্থায় বিশ্বাসী পাহাড়ীরা নানাভাবে জটিল সমস্যার মধ্যে জীবন অতিবাহিত হতে হতে একসময় তারাও বুঝে নিতে শিখে তাদের অধিকার , আর যার ফলে একসময় বিদ্রোহের আগুনে ঝলসে নেয় তাদের চিন্তাধারাকে। শুরু হয় পাহাড়ী-বাঙালী সন্ত্রাস, যা ত্রিপুরার বুকে মান্দাই হত্যাকাণ্ড (১৯৮০খ্রিঃ) নামে খ্যাত। অপরদিকে, মুষ্টিমেয় কিছুসংখ্যক সুবিধেবাদী বাঙালী উদ্বাস্তু মহাজনী কায়েমী স্বার্থের লোক বাদ দিলে বাকী শরণার্থী ছিন্নমূল বাঙালী সেদিন অচিন দেশে এসে স্বজনহারা দুঃখের সঙ্গে বাস্তুহারা বেদনাকে ভুলতে চেয়েছিল ত্রিপুরার মাটিকে আকড়ে ধরে।যদিও তাতে ততোটা সমস্যায় পড়তে হয়নি যতটা পড়তে হয়েছিল ভূমিপুত্রদের। যার ফলস্বরূপ আমরা ত্রিপুরার বাংলা সাহিত্যে উদ্বাস্তু বাঙালীর সমস্যা-সংকটের চেয়ে পাহাড়ী আদিবাসীদের জীবনযন্ত্রণার কথা বেশী প্রস্ফুটিত হতে দেখি। আদিবাসীরা সেদিন নিজ রাজ্য ত্রিপুরায় থেকেও ভাষার সংকট, বাসস্থানের সংকট এমনকি কোথাও আবার খাদ্য সংকটেরও সম্মুখীন হয়।
***********************************************************************
তথ্যসূত্রঃ
১। দত্ত রমাপ্রসাদ ও দাশ নির্মল সম্পাদিত, ‘শতাব্দীর ত্রিপুরা’, প্রথম সংস্করণ ২০০৫খ্রিঃ, অক্ষর প্রকাশনী, আগরতলা, ত্রিপুরা, পৃষ্ঠা- ২০৫।
২। তদেব, পৃঃ-২০৫
৩। দেবনাথ জহর, ‘ধলাইপারের রূপকথা’, প্রথম সংস্করণ ২০০২ খ্রিঃ, ভাষা প্রকাশনী, আগরতলা, ত্রিপুরা, পৃষ্ঠা- ১৭ ।
৪। সরকার প্রদীপ, ‘ছিপ’, প্রথম সংস্করণ ২০০৬ খ্রিঃ, ভাষা প্রকাশনী, আগরতলা, ত্রিপুরা, পৃষ্ঠা-১৭।
৫। তদেব, পৃষ্ঠা-২৬ ।
৬। সরকার সুধীর, ‘অবোধবেলা’, প্রথম সংস্করণ ২০০১ খ্রিঃ, আগরতলা, ত্রিপুরা, মনোবীজ প্রকাশনী, পৃষ্ঠা-৫১ ।
৭। তদেব, পৃষ্ঠা-৫১ ।
৮। দেববর্মা নন্দকুমার, ‘ঠিকানা কিরাতভূমি’, প্রথম সংস্করণ ২০০০খ্রিঃ, ত্রিপুরা দর্পণ প্রকাশনী, আগরতলা, ত্রিপুরা, পৃষ্ঠা- ৭ ।
৯। তদেব, পৃষ্ঠা- ৩৪ ।
১০। সিংহ বিমল, ‘বিমল সিংহ রচনাসমগ্র’, প্রথম সংস্করণ ১৯৯৯ খ্রিঃ, ত্রিপুরা দর্পণ প্রকাশনী, আগরতলা, ত্রিপুরা, পৃষ্ঠা-২৮৫ ।
১১। তদেব, পৃষ্ঠা- ২৮৫ ।
********************************************************************************
No comments:
Post a Comment